যারা অন্যায় করেছে তাদের বিচার হবেই: প্রধানমন্ত্রী

বিশেষ প্রতিনিধি।। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দৃঢ়কণ্ঠে বলেছেন, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের সময় নির্বিচারে সামরিক অফিসার হত্যাকাণ্ড, বিগত বছরগুলোতে অগ্নি সন্ত্রাসে জড়িতদের বিচার করা হবে। অন্যায় যারা করেছে তারা কিন্তু শাস্তি পাবে। শাস্তি পেয়েছে, পাচ্ছে এবং পাবে। আরও যারা বাকি আছে সেটা (বিচার) আমরা অবশ্যই করবো।

মঙ্গলবার (১৮ এপ্রিল) গণভবনে জিয়াউর রহমানের সময়ে নিহত সামরিক সদস্যদের পরিবার, বিগত বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলনে অগ্নিদগ্ধ আহত এবং নিহতদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময়কালে এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৭৭ সালে যাদের হত্যা করেছে, ’৭৫ সালের পর থেকে যাদের হত্যা করা হয়েছে, মানুষ তো এগুলো ভুলে যাচ্ছিল। এটা আজকে মানুষের সামনে আসছে যে জিয়াউর রহমান কী অপরাধ করেছে। জিয়া যেমন করলো, তার বউ করলো এবং তার ছেলেরা মিলে পরে এই অগ্নিসন্ত্রাস করলো। এরা এদেশের কোনও মঙ্গল চায় না, এরা এদেশের মানুষের কোনও ভালো চায় না। এটাই হলো বাস্তবতা।

অনুষ্ঠানে শুরুতে জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনের সময়ে কিভাবে বিনাবিচারে সেনাবাহিনী ও বিমান বাহিনীর সদস্যদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়েছে তার ওপর একটি তথ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। এসময় ভুক্তভোগী কয়েকজনের পরিবারের সদস্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে এসব ঘটনার বিচার চান।

এছাড়া আন্দোলনের নামে ২০১৩, ১৪ ও ১৫ সালে বিএনপি জামায়াতের ভয়াল অগ্নি-সন্ত্রাসের ওপর নির্মিত আরেকটি ভিডিও চিত্রও প্রদর্শন করা হয়। সেই সময়ের কয়েকজন ভুক্তভোগি প্রধানমন্ত্রীর সামনে বক্তব্য রেখে এই ঘটনার বিচার চান। অনুষ্ঠান শেষে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের সদস্যদের হাতে ঈদ উপহার তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী। অনুষ্ঠানে বঙ্গবাজারের ক্ষতিগ্রস্থ কয়েকজন ব্যবসায়ীও ছিলেন। পরে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবাজারের দোকান মালিক ও কর্মচারী প্রতিনিধিদের হাতে সেখানকার দোকান মালিক ও কর্মচারীদের জন্য ঈদ উপহার দেন।

বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, বাংলাদেশের জন্য আমার আব্বা সারাজীবন কষ্ট করে গেছেন। আমার একটাই চেষ্টা দেশের মানুষ যেন একটু ভালো থাকে। আজকে মানুষ যখন একটু ভালো অবস্থার দিকে যাচ্ছে, একটু অর্থনৈতিকভাবে স্বচল হচ্ছে ঠিক সেসময় আবারও অগ্নি-সন্ত্রাস, মার্কেটে আগুন, নানাভাবে মানুষকে ক্ষতি করা। এটা যারা করে এদের প্রতি জাতির ঘৃণা। আমার মনে হয় আল্লাহ সহ্য করবেন না। এরা যে অপরাধ করেছে তাদের বিচার হবে।

সরকার প্রধান বলেন, দিনের পর দিন ফাঁসির ঘটনা, বিদেশ থেকেই খবরগুলো শুনতাম। জেলখানায় চার নেতাকে হত্যা করলো। কোনও অপরাধ নেই জানে, তারপরও ধরে নিয়ে গিয়ে ফাঁসি দেওয়া। পাকিস্তানিবাহিনী যেমন বর্বরতা চালিয়েছিলে এই বিএনপি জামায়াতও একই বর্বরতা চালায়। জিয়াউর রহমান তো হাসতে হাসতে নাকি ফাঁসির রায় লিখতো। কোনও বিচার নাই। ফাঁসি দেওয়া হয়ে গেছে। বিচারের রায় বের হয়েছে পরে। কি জুলুম? কি অত্যাচার? কি অন্যায়?

অনুষ্ঠানে ’৭৫ পরবর্তী অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে জিয়াউর রহমানের নির্বিচারে মানুষ হত্যার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ১৯৭৭ সালে বিমানবাহিনী, আর্মি কর্মকর্তাদের নির্মমভাবে হত্যা করেছে। আমি আমার গ্রামেও একজনকে খুঁজে পেয়েছিলাম, তার ছেলে মেয়েদের আমি দেখতাম। এরপর আমি অনেক চেষ্টা করেছিলাম এসব নামদাম জোগাড় করতে। শুরুতে পাওয়া এটা কষ্টকর ছিল। পরে আস্তে আস্তে নামগুলো পাই।

ভুক্তভোগীদের কথা শোনার পরে প্রধানমন্ত্রীর তাঁর বক্তব্যে পঁচাত্তরে ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যার পর থেকে শুরু হওয়া হত্যাকান্ডের চিত্র তুলে ধরেন। শেখ হাসিনা বলেন, যখন বিরোধী দলে ছিলাম এমন একটা দিন নাই যে লাশ টানতে হয়নি। আওয়ামী লীগের অগণিত নেতাকর্মীদের হত্যা করা হয়েছে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, এরপরও কি করে এদের পাশে লোক থাকে? আমি বুঝে উঠতে পারিনা। ২০১৩ সালের পরবর্তী সময়ের অগ্নি-সন্ত্রাসের দিকে ইঙ্গিত করে সরকারপ্রধান বলেন, একটা জীবন্ত মানুষকে কিভাবে পোড়ানো যায়? যাদের কোনও অপরাধ নেই। বুঝলাম আওয়ামী লীগের যারা রাজনীতি করেছে, তাদের তারা মেরেছে। কিন্তু যারা সাধারণ মানুষ তাদের ওপর এই জলুম অত্যাচার কেন?

স¤প্রতি বিভিন্ন মার্কেটে আগুন লাগার ঘটনার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আবার এখন দেখেন, কয়েকদিন ধরে হঠাৎ করেই যেন মার্কেটে আগুন লাগাটা বেড়ে গেলো। হঠাৎ আমার মনে সন্দেহ লাগলো এটাও কি নাশকতা নাকি? যারা গাড়িতে আগুন দিয়ে, বাসে আগুন দিয়ে, রিকশায় আগুন দিয়ে জীবন্ত মানুষকে পোড়াতে পারে এরা মানুষের ক্ষতি করাটাই জানে। ঈদের সময় মানুষ একটু ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারে, সেই পথটাও যেন তারা বন্ধ করে দিতে চায়। আমার তো মনে এখানেও কিছু এটা ঘটনা আছে।

শেখ হাসিনা বলেন, যারা আপনজন হারিয়ে কষ্ট করে বড় হয়েছেন শুধু এটুকু বলতে পারি তাদের সান্তনা দেওয়ার ভাষা আমার নাই। আমি আপনাদের মতো, হঠাৎ একদিন দেখলাম আমার কেউ নেই। বিদেশে বোনকে নিয়ে বাচ্চাদের নিয়ে অসহায় অবস্থায় ছয় বছর রিফিউজির মতো থাকতে হয়েছে। কাজেই আমরা এই কষ্টটা বুঝি।

বিচারের আশ্বাস দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, শুধু এটুকু বলবো যারা এই অন্যায় করেছে তারা কিন্তু শাস্তি পাবে। শাস্তি পেয়েছে, পাচ্ছে, পাবে। আরও যারা বাকি আছে সেটা (বিচার) আমরা অবশ্যই করবো। এরা যে অপরাধ করেছে তার বিচার হবে। দিনের পর দিন ফাঁসির ঘটনা, আমরা বিদেশে থেকেও এই খবরগুলো শুনতাম। কোন অপরাধ নেই ধরে নিয়ে গিয়ে ফাঁসি দেওয়া। জিয়াউর রহমান তো হাসতে হাসতে মানুষের ফাঁসির রায় লিখতো। কোন বিচার ছিল না।

নিজেকে স্বজনহারা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমি তো একজন স্বজনহারা। আমি চিন্তা করলাম যারা আমার মতো স্বজনহারা তাদের সঙ্গে একটু মতবিনিময় করবো, দেখা করবো, সেজন্যই আপনাদেরকে কষ্ট করে ডাকা।

বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, ৩৫ বছর লেগেছে আমার বাবা-মার হত্যার বিচার করতে। কারণ আইন করে দিয়েছিল। আমি দেশে ফিরে আসলাম, আমি মামলা করতে পারবো না, বিচার চাইতে পারবো না। সেই খুনিদের এভাবে রেহাই দেওয়া হয়েছিল। আমরা সরকারে আসার পর ইনডেমনিটি বাতিল করে বিচার করতে গেছি সেখানেও তো কতো বাঁধা। জজ সাহেবরা রায় দিতে যেতে পারেন না, বোমা মারে। হরতাল ডাকে, অনেক জজ সাহেবরা বিব্রতবোধ করেন। এটাও আমাকে দেখতে হয়েছে। যেখানে এতোগুলো মানুষ হত্যা হলো তার বিচারের রায়টা দিতেও তারা লজ্জ্বাবোধ করেন। আমি আপনাদের কষ্ট বুঝি, কারণ আমিও তো একই কষ্ট পেয়েছি। যেটুকু পারি আমি আমার তরফ থেকে করে যাবো।

অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রি আ ক ম মোজাম্মেল হক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল উপস্থিত ছিলেন। সভা সঞ্চালনা করেন আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আবদুর সোবহান গোলাপ।

২০১৪ সালে বিএনপি-জামায়াতের অগ্নি-সন্ত্রাসের শিকার রূপগঞ্জের মো. সালাউদ্দিন অনুভ‚তি প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন, আমি যখন আপনাদের সঙ্গে কথা বলছি ঠিক তখন আমার সামনে একটা সুস্থ মানুষের ছবি আপনারা দেখতে পাচ্ছেন সেটা আমি। আর একই ফ্রেমের নিচে ঝলসে যাওয়া ছবিটাও আমার। দেখুন আমাকে কী করে দেওয়া হলো। আমি একটা সাধারণ মানুষ। কেন আমার এত বড় ক্ষতি করা হলো? আমি খুবই দুঃখি মানুষ। কিন্তু ১৯৭৭ সালে বিমানবাহিনীর কর্মকর্তাদের অনৈতিকভাবে ফাঁসি দিয়ে হত্যার গল্প যখন কারও স্বামী, কারও সন্তানের মুখে শুনছিলাম তখন নিজের দুঃখের কথা ভুলে গেছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করে সালাউদ্দিন বলেন, আপনার কিছু আমার কিছু চাওয়ার নেই। আপনার কারণে আমি সুচিকিৎসা পেয়েছি। এখনো সমস্যায় পড়লে আপনার সহায়তা পাই। আপনি মানবতার মা। আমার মতো অনেককে আগলে রেখে দেশটাকে পরিচালনা করছেন। তাই দেশের মানুষ চায় আপনি বারবার দেশের নেতৃত্ব দিন, আমিও চাই।

ওই সময় অগ্নিসন্ত্রাসের শিকার হয়ে দুই হাতের কবজি পর্যন্ত হারান পুলিশের এস আই মকবুল হোসেন বলেন, কেবল আমি পুলিশে যোগ দিয়েছি। তখনো বেতন হয়নি। চাকরির এক মাস ১১ দিনের মাথায় অগ্নি-সন্ত্রাসের শিকার হই। আমার বাঁচার কথা ছিলো না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ধন্যবাদ জানাই তিনি সে সেময় আমার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন। আমি তো পুলিশ বাহিনীর একজন সদস্য এখনো চাকরি করছি। পুলিশবাহিনীর একজন সদস্য হিসেবে আমি গর্বিত। ২০১৪-১৫ সালে জামায়াত-বিএনপির তাÐবে আমাদের পুলিশবাহিনীর অনেকগুলো মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে। অনেক পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। পুলিশ দেশের জন্য জীবন দেয়। দেশের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য পুলিশবাহিনীর সদস্য আগামীতেও প্রাণ দিতে প্রস্তুত। তিনি বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনার প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা। আপনি প্রয়োজন মনে করে আজ আমাদের ডেকে এনেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমার সন্তান আমাকে জিজ্ঞেস করে আমার হাত কোথায় গেল, আমার হাতের অবস্থা এমন কেন, আমি কোনো জবাব দিতে পারি না। আমি আমার সন্তানকে জড়িয়ে ধরে হাত বুলিয়ে দিতে পারি না। এর যে কী কষ্ট তা বলে বোঝানোর মতো না। আমি এর বিচার চাই।

বিমানবাহিনীকে কর্মরত সার্জেন্ট মোশারফকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে জিয়াউর রহমান এমনটা উল্লেখ করে তার কন্যা বলেন, আমার বাবা বেঁচে থাকলে হয়তো অন্য অনেকের মতো পড়ালেখা করে বিরাট কিছু হতে না পারলেও অন্তত একটা কিছু করে খেতে পারতাম। কিন্তু খুনী জিয়া আমার বাবাকে অকারণে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারে। এরপর কত কষ্ঠে জীবন কাটিয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। একদিকে বাবা হারানোর শোক। অন্যদিকে মানবেতর জীবন। মানুষের কাছে বলতে গেলে মানুষ আমাকে বলে আমি নাকি অভিনয় করি। কেউ বলে পাগলী মেয়ে। তিনি বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি মানবতার মা। আমার বুকে অনেক কষ্ট। আমি কথা গুছিয়ে বলতে পারি। কী ভাষায় আমি আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানাবো সে ভাষা আমার নেই। শুধু বলবো আমাদের দুঃসময়ে আপনি আমাদের কাছে ডেকেছেন। খোঁজ খবর রাখছেন এর প্রতিদান আল্লাহ আপনাকে দিকে। এসময় তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। প্রধানমন্ত্রীকে তার মাথায় হাতবুলিয়ে দিতে বলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চেয়ার থেকে উঠে জড়িয়ে ধরে শান্তনা। সার্জেন্ট মোশারফের মেয়ে এসময় কান্নায় ভেঙে পড়েন

প্রধানমন্ত্রীর সামনে অনুভ‚তি প্রকাশ করেন ’৭৭ সালে স্বামীহারা সার্জেন্ট দেলোয়ারের স্ত্রী নূর নাহার বেগম। তিনি বলেন, স্বামীকে কোনো কারণ ছাড়াই জিয়াউর রহমান হত্যা করে। তার পরিবারকে না জানিয়ে ফাঁসি দেয় এবং কবর কোথায় দেয় সেটাও বলেনি। এতদিন আমরা জানতে পারিনি আমার স্বামীর কবর কোথায়। এখন অনেকে লেখালেখি করছেন তারা জানাচ্ছেন কবর আজিমপুর কবরস্থানে। এসময় তিনি এই সংক্রান্ত একটি রিট করেছেন সেই রিটের অগ্রগতির জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহায়তা চান। এছাড়া ওইসময়ে আমার স্বামীসহ যাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মেরেছেন তাদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য একটি স্মৃতি স্তম্ভ তৈরি করার প্রস্তাব দিয়ে তিনি বলেন, যা দেখলে খুনি জিয়াকে মানুষ ধিক্কার জানাতে পারবে। নূর নাহার বেগমের সন্তান তার পাশে এসে কথা বলেন। তিনি বলেন, একজন সন্তান হিসেবে এটা কষ্টের যে পিতার কবরটা কোথায় আছে তা জানতে না পারা। এমন জঘন্য কাজ যিনি করেছেন আমরা তার বিচার চাই।

 

এই বিভাগের আরো খবর