রেকর্ড আমদানির পরও দাম বাড়তি

চট্টগ্রাম প্রতিনিধি : রমজানের অত্যাবশ্যকীয় হিসেবে বিবেচিত পণ্যগুলো এবার রেকর্ড পরিমাণে আমদানি হয়েছে। বাজারে পণ্যের সরবরাহ সংকট নেই। তবুও পাইকারি ও খুচরা বাজারে সেভাবে দাম কমছে না। এক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের বাড়তি দামকে অজুহাত হিসেবে দেখাচ্ছেন।

রমজানকে সামনে রেখে যেসব পণ্যের চাহিদা বেড়েছে, সেগুলো হলো- ছোলা, ডাল, ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, গম ও খেজুর।

চট্টগ্রামের ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জের আড়তে এসব পণ্যের মজুদে ঘাটতি নেই। সেখানে ঘুরে দেখা গেছে, ট্রাকে-ট্রাকে আসছে রমজানের পণ্য।

পাইকারি ব্যবসায়ীরাও বলছেন, বাজারে রমজানের পণ্যের সরবরাহ সংকট নেই। আন্তর্জাতিক বাজারে বুকিং রেট কম থাকলেও দেশে ডলারের দাম বাড়তি থাকায় আমদানির ক্ষেত্রে খরচ বেশি হচ্ছে। এর ফলে দাম সেভাবে না কমলেও বাজার স্থিতিশীল আছে বলে তাদের দাবি।

দেশে ছোলার চাহিদা বছরে দেড় লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে শুধু রমজানে চাহিদা থাকে এক লাখ টনের। এই চাহিদার বিপরীতে প্রায় দুই লাখ টন ছোলা আমদানির তথ্য পাওয়া গেছে। চট্টগ্রাম কাস্টমসের কমকর্তারা জানিয়েছেন, বছরজুড়ে আমদানি স্বাভাবিক থাকার পর ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গত তিন মাসে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ৬৬ হাজার ৪২২ মেট্রিক টন ছোলা এসেছে।

পর্যাপ্ত মজুদ থাকার পরও ছোলার বাড়তি দামের তথ্য এসেছে রাষ্ট্রায়ত্ব বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসেবেও। সংস্থার তথ্যমতে, দেশের বিভিন্ন বাজারে এখন খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি ছোলা বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ৯৫ টাকায়, যা এক মাস আগেও ছিল ৮৫ থেকে ৯০ টাকা। খাতুনগঞ্জে ভালো মানের ছোলা বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৮৫ টাকায়। কিন্তু খুচরাতে গিয়ে কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা বেড়ে যাচ্ছে ছোলার দাম।

পাইকারি ব্যবসায়ীদের দেওয়া তথ্যে জানা গেছে, বর্তমানে পাইকারিতে অস্ট্রেলিয়া থেকে আমদানি হওয়া ছোলা প্রতি মণ ৩১০০ থেকে ৩৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক মাস আগেও ২৬০০ থেকে ৩০০০ টাকার মধ্যে বিক্রি হয়েছিল।

চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আড়ৎদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাবেক সভাপতি মেসার্স তৈয়বিয়া ট্রেডার্সের স্বত্তাধিকারী সোলায়মান বাদশা সারাবাংলাকে বলেন, ‘রমজানে ৮০ হাজার টন ছোলার চাহিদা থেকে। তার থেকে দুই তিনগুণ বেশি ছোলা মজুদ রয়েছে। আরও আসছে। রমজানের একেবারে আগেভাগে দাম কমে যাবে। ডলারের দাম বাড়তি, সেজন্য বাজারে দাম কিছুটা বাড়তি। তবে সেটাও কমে আসবে।

রমজানে দেশে তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ মেট্রিক টন ভোজ্যতেলের চাহিদা থাকে বলে জানিয়েছেন চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা। গত ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আমদানি হয়েছে তিন লাখ ৭০ হাজার ৮২ মেট্রিক টন, কাস্টমসের তথ্য অনুযায়ী।

বাজার ঘুরে দেখা গেছে, চাক্তাই-খাতনুগঞ্জে সয়াবিন তেল মণ প্রতি ৬৫৮০ টাকা, পাম অয়েল ৪৯৪০ টাকা এবং সুপার সয়াবিন ৫১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। একই বাজারে পাইকারি পর্যায়ে গত সপ্তাহে সয়াবিন তেল মণপ্রতি ৬৩৮০ টাকা, পাম অয়েল ৪৭০০ টাকা এবং সুপার সয়াবিন ৫১২০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল।

ভোজ্যতেলের পাইকারি বিক্রেতা খাতুনগঞ্জের মেসার্স আব্বাস আলী সওদাগরের ব্যবস্থাপক জাফর আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত সপ্তাহের তুলনায় এ সপ্তাহে ভোজ্যতেলে মণপ্রতি ২০০ থেকে ৩০০ টাকা করে দাম বেড়েছে। লিটার প্রতি ছয় থেকে সাত টাকা বেড়েছে। এখানে আমাদের কিছু করার নেই। আমদানিকারকরা আমাদের যে দামে তেল সরবরাহ করছেন, আমরা সে দামেই বিক্রি করছি। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বেড়েছে, গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ায় পরিশোধন ব্যয়ও বেড়েছে।’

মেসার্স তৈয়বিয়া ট্রেডার্সের সোলায়মান বাদশা সারাবাংলাকে বলেন, ‘তেলের বাজার দেশের বেশ কয়েকটি শিল্পগ্রুপের হাতে। তারা যে দাম নির্ধারণ করে দেয়, সেভাবেই আমাদের বিক্রি করতে হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়ল নাকি কমলো সেটার তোয়াক্কা করে না তারা।

চিনির বাজারেও চলছে অস্থিরতা। ব্যবসায়ীদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে প্রায় ২০ লাখ টন চিনির চাহিদা থাকে, যার ৯৫ শতাংশের বেশি আমদানি করতে হয়। দেশে আখ থেকে চিনি উৎপাদন হয় ৩০ হাজার মেট্রিক টন। বাকিটা আমদানি করেই মেটানো হয়। প্রতি মাসে গড়ে চিনির চাহিদা দেড় লাখ টন থাকলেও রমজানে চিনির চাহিদা বেড়ে তিন লাখ টন হয়।

ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সাত মাসের আমদানি চিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, চাহিদার কাছাকাছি চিনি আমদানি হয়েছে দেশে। ডিসেম্বর পর্যন্ত আমদানি কিছুটা কম থাকলেও গত দুই মাসে চিনির সরবরাহ আগের চেয়ে বেড়েছে। গত জুলাই-ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে আমদানি হয়েছে ৬ লাখ ৮৫ হাজার মেট্রিকটন চিনি।

খাতুনগঞ্জের বাজারে মণপ্রতি চিনি বিক্রি হচ্ছে ৩৯৪০ থেকে ৩৯৫০ টাকা। এক সপ্তাহের ব্যবধানে মণপ্রতি ১০০ টাকারও বেশি এবং কেজিপ্রতি ছয় টাকা বেড়েছে বলে জানালেন ব্যবসায়ীরা।

বাজারে পেঁয়াজের দামও ঊর্দ্ধমুখী। ব্যবসায়ীদের দাবি, হিলি স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে পেঁয়াজ আসার পরিমাণ গত একমাসে কমেছে। এজন্য সদ্য শেষ হওয়া সপ্তাহের শেষ তিনদিনে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে।

পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি ভারতীয় পেঁয়াজ ৩২ টাকা ও দেশি পেঁয়াজ ১৮ থেকে ২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক সপ্তাহ আগে বিক্রি হয়েছে যথাক্রমে ২৪ থেকে ২৬ টাকা এবং ১৫ থেকে ১৬ টাকায়।

খাতুনগঞ্জের মেসার্স মেহের ট্রেডার্সের স্বত্ত্বাধিকারী রমজান তালুকদার আলী সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাজারে পেঁয়াজের সংকট তেমন নেই। তবে প্রতিবছর একটা নির্দিষ্ট সময় ভারত থেকে পেঁয়াজ আসা কমে যায়। এবারও সেই কারণে পেঁয়াজের বাজার কিছুটা অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে।’

চট্টগ্রামের খুচরা বাজারে কেজিপ্রতি মসুর ডাল ১৩৩ থেকে ১৩৫ টাকা, আদা ১০৫ থেকে ১১০ টাকা, রসুন ১০০ থেকে ১০৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

এদিকে সারাবছর দেশে যে পরিমাণ খেজুরের চাহিদা থাকে তার অর্ধেকই বিক্রি হয় রমজানে। বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) হিসেবে, দেশে সারাবছর খেজুরের চাহিদা থাকে প্রায় এক লাখ টন। শুধু রমজানে এই চাহিদা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৪৫ থেকে ৫০ হাজার টন। কিন্তু এ বছর আমদানি কম হয়েছে। গত নভেম্বর-জানুয়ারি মাসে তিন মাসে খেজুর আমদানি হয়েছে ২২ হাজার ৭০০ টন। গত বছর একই সময়ে আমদানি ছিল ৪০ হাজার ৮০০ টনের বেশি। অর্থাৎ এক বছর আগের একই সময়ের চেয়ে এ বছর আমদানি প্রায় ৪৫ শতাংশ কমেছে।

চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্র বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে খেজুর আমদানি হয়েছিল ৯১ হাজার ৯০৪ টন। তবে এই অর্থবছরের প্রথম আট মাসে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে খেজুর আমদানি হয়েছে প্রায় ৬০ হাজার টন।

তবুও রোজা ঘিরে আগেভাগেই বেড়ে গেছে খেজুরের দাম। পাঁচ কেজির কার্টনে খেজুরের দাম বেড়েছে ৩০০ থেকে ৮০০ টাকারও বেশি।

নগরীর ফলমুন্ডির খেজুর আমদানিকারক অ্যারাবিয়ান ডেটস সুপার শপের মালিক জয়নাল আবেদিন আবির সারাবাংলাকে জানান, গত বছরের তুলনায় এবার খেজুরের আমদানি খরচ বেশি পড়েছে, তাই দাম বেশি। গত বছর ১০ কেজির এক প্যাকেট জাহিদি খেজুর বিক্রি হয়েছে ৮৫০ টাকায়, এ বছর তা বিক্রি হচ্ছে ১২৫০ টাকায়। আর মরিয়ম খেজুর ৫ কেজির প্যাকেট এবার বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৪০০ থেকে ৩ হাজার ৫০০ টাকায়। গত বছর তা বিক্রি হয়েছে ৩ হাজার ২০০ টাকায়।

মাবরুম খেজুর মানভেদে বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ২০০ থেকে ৪ হাজার ৫০০ টাকায়। গত বছর বিক্রি হয়েছিলো ২ হাজার ৪০০ থেকে ৩ হাজার ২০০ টাকায়। আজওয়া খেজুর বিক্রি হচ্ছে মানভেদে ২ হাজার ৬৫০ টাকা থেকে ৩ হাজার টাকায়, গত বছর বিক্রি হয়েছিল ২ হাজার থেকে ২ হাজার ২০০ টাকায়। মাসরুক খেজুর এ বছর বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার টাকায়, একই খেজুর গত বছর বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ৬০০ টাকায়।

মার্চের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত কাস্টমসের দেওয়া হিসেব অনুযায়ী, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ছোলা ৬৬ হাজার ৪২২ টন, মশুর ডাল ৯০ হাজার ৩৯২ টন, রসুন ১৪ হাজার ১২১ টন, আদা ২৭ হাজার ৪৩৮ টন, খেজুর ৩২ হজার ২০৯ টন এবং গম ৬ লাখ ৭২ হাজার ৫৮৬ টন আমদানি হয়েছে।

এই বিভাগের আরো খবর