শহীদ মিনারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমাবেশ

রাষ্ট্রপতির পদত্যাগসহ ৫ দাবি

বিশেষ প্রতিনিধি।।

 

চলতি সপ্তাহের মধ্যে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগ, ছাত্রলীগ নিষিদ্ধসহ মোট পাঁচ দফা নতুন দাবি ঘোষণা করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।

 

মঙ্গলবার বিকেলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাদদেশে অনুষ্ঠিত গণজমায়েত থেকে এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ। একই সঙ্গে অবিলম্বে এসব দাবি মেনে নেওয়া না হলে শীঘ্রই রাজপথে কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি।

অন্যদিকে, ‘স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষা কমিটি’ ব্যানারে বঙ্গভবনের সামনে আন্দোলন বিক্ষোভ সমাবেশ করছেন একদল শিক্ষার্থী। সেখান থেকে আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগের আল্টিমেটাম দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে দাবি মেনে নেওয়া না হলে বঙ্গভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালনেরও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে। তবে রাতে কর্মসূচি স্থগিত করে আন্দোলনকারীরা জানান, আজ বুধবার বিকেলে আইন উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের পর পরবর্তী সিদ্ধান্ত জানানো হবে।

এদিকে, মঙ্গলবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এ ব্যাপারে প্রধান উপদেষ্টার উপ প্রেস সচিব অপূর্ব জাহাঙ্গীর বলেন, রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের বিষয়ে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুলের মতামতের সঙ্গে একমত পোষণ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। রাষ্ট্রপতিকে সরানোর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ নিয়ে বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দেওয়ায় রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগের দাবিতে শহীদ মিনারে এই সমাবেশ ডাকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে সমাবেশ শুরু হয়।

সেখানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা বলেন, ‘আপনার (রাষ্ট্রপতি) সময় শেষ হয়ে গেছে। ছাত্র-জনতা আর আপনাকে রাষ্ট্রপতি পদে দেখতে চায় না। হয় আপনি পদত্যাগ করুন, না হলে ছাত্র-জনতা বঙ্গভবন ঘেরাও করে শেখ হাসিনার মতো পালাতে বাধ্য করাবে। সব জায়গা থেকে স্বৈরাচারের দোসরদের বিদায় করতে হবে। ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করতে হবে। ছাত্র-জনতার এই স্পিরিট নতুন বাংলাদেশ গঠনের আগ পর্যন্ত থাকবে উল্লেখ করে তারা বলেন, ’৭২-এর ফ্যাসিবাদী সংবিধান বাতিল করে নতুন সংবিধান প্রণয়নের আগ পর্যন্ত আমরা রাজপথে থাকব।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমাবেশ থেকে ঘোষিত নতুন পাঁচ দফা দাবির মধ্যে রয়েছে- (১) অনতিবিলম্বে ’৭২-এর সংবিধান বাতিল করতে হবে। সেই জায়গায় ’২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের পক্ষ থেকে নতুন করে সংবিধান লিখতে হবে। (২) এই সপ্তাহের মধ্যে ছাত্রলীগকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। তাদের আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ করতে হবে। (৩) এই সপ্তাহের মধ্যে বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে পদচ্যুত করতে হবে। (৪) জুলাই বিপ্লব ও গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিটের আলোকে ২৪ পরবর্তী বাংলাদেশ বিনির্মাণে এই সপ্তাহের মধ্যে নতুন করে রূপরেখা প্রণয়ন করতে হবে এবং (৫) ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনকে অবৈধ ঘোষণা করতে হবে। এসব নির্বাচনে যারা নির্বাচিত হয়েছিল তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে হবে। একই সঙ্গে তারা যেন ২৪ পরবতীঁ বাংলাদেশে কোনোভাবেই প্রাসঙ্গিক হতে না পারে এবং নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে সে জন্য আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।

সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ এই পাঁচ দাবি ঘোষণা করে বলেন, যে শহীদ মিনার থেকে আমরা এক দফা দাবি তুলেছিলাম, সেই শহীদ মিনার থেকে আমরা পাঁচ দফা ঘোষণা দিচ্ছি। এই সপ্তাহের মধ্যে আমাদের পাঁচ দফা দাবি না মানা হলে আমরা আবার রাজপথে নেমে যাব।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসউদ রাষ্ট্রপতিকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আপনার সময় শেষ হয়ে গেছে। ছাত্র-জনতা আর আপনাকে রাষ্ট্রপতি পদে দেখতে চায় না। হয় আপনি পদতাগ করুন না হলে ছাত্র-জনতা বঙ্গভবন ঘেরাও করে শেখ হাসিনার মতো পালাতে বাধ্য করাবে। ছাত্র-জনতার এই স্পিরিট নতুন বালাদেশ গঠনের আগ পর্যন্ত থাকবে। বাহাত্তরের ফ্যাসিবাদী সংবিধান বাতিল করে নতুন সংবিধান প্রণয়নের আগ পর্যন্ত আমরা রাজপথে থাকব।’

গণজমায়েতে অপর অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেন, আবারও যদি প্রয়োজন হয় আমরা আমাদের চোখ দিতে প্রস্তুত, পা দিতে প্রস্তুত, হাত দিতে প্রস্তুত, এমনকি জীবন দিতেও প্রস্তুত আছি। ফ্যাসিস্ট দল ছাত্রলীগ যেভাবে আমাদের ভাইদের হত্যা করেছে, তাদের উত্থান সহ্য করা হবে না। রাষ্ট্রপতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কী খেয়ে, কার কথা শুনে, মানসিক অবস্থান কোন পর্যায়ে ও কার চক্রান্তে আপনি বলছেন যে, আপনার কাছে পদত্যাগপত্র নেই? আমরা রাষ্ট্রপতিসহ তাদের দোসরদের একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, আমরা যদি বাংলাদেশে ফ্যাসিস্ট ও খুনিদের কোনো উৎপাত লক্ষ্য করি. ছাত্র-জনতা ৫ আগস্টের মতো ঐক্যবদ্ধভাবে তা প্রতিহত করবে।

সমাবেশে অংশ নিয়ে শিক্ষার্থীরা ‘আমাদের সংগ্রাম, চলছে চলবে’; ‘আবু সাঈদ মুগ্ধ, শেষ হয়নি যুদ্ধ’; ‘অ্যাকশন অ্যাকশন, ডাইরেক্ট অ্যাকশন’; ‘আওয়ামী লীগের দালালেরা হুঁশিয়ার সাবধান’; ‘ছাত্রলীগের দালালেরা হুঁশিয়ার সাবধান’; ‘স্বৈরাচারের দোসরেরা হুঁশিয়ার সাবধান’; ‘অবৈধ রাষ্ট্রপতি, মানি না মানব না’; ‘আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ কর, করতে হবে’ ইত্যাদি বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন।

এ সমাবেশে আরও বক্তব্য রাখেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নুসরাত তাবাসসুম, আব্দুল হান্নান, আবু বাকের মজুমদার, রিফাত রশীদ প্রমুখ।

বঙ্গভবনের সামনেও বিক্ষোভ ॥ ‘স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষা কমিটি’ ব্যানারে বঙ্গভবনের সামনে বিক্ষোভ করেছেন করেছেন এক দল শিক্ষার্থী। রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগসহ চার দফা দাবিতে বঙ্গভবন ঘেরাও কর্মসূচিতে অংশ নেন তারা।

মঙ্গলবার দুপুর ২টার দিকে তারা বঙ্গভবনের প্রধান ফটকের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। রাষ্ট্রপতি পদত্যাগের দাবিতে বিভিন্ন স্লোগান দেন বিক্ষোভকারীরা। এ ঘটনায় বঙ্গভবনসহ আশপাশের এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। বিপুল সংখ্যক পুলিশ, সেনাবাহিনীর এপিসি ও জলকামান মোতায়েন করা হয়।

এর আগে মঙ্গলবার দুপুর ১২টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাজু ভাস্কর্য থেকে মিছিল শুরু করে বঙ্গভবনের দিকে যায় স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষা কমিটি। হাইকোর্ট মাজার মোড় এলাকায় পুলিশের বাধা অতিক্রম করে বঙ্গভবন পর্যন্ত এগিয়ে যায় মিছিল। তারা বঙ্গভবনের ভেতরে ঢুকতে চাইলে পুলিশের বাধার মুখে পড়ে। পরে রাষ্ট্রপতির বাসভবনে সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন বিক্ষোভকারীরা। পাশেই রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবিতে ‘রক্তিম জুলাই-২০২৪’ ব্যানারে দাঁড়িয়ে বিক্ষোভ করতে দেখা যায় আরেকটি গ্রুপকে।

বিক্ষোভে অংশ নেওয়া ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আহত ছাত্রদের সংগঠন ও রক্তিম জুলাই-২০২৪ সংগঠনের সংগঠক এমদাদ বাবু রাষ্ট্রপতিকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি পদ থেকে আপনি মিথ্যাচার করেছেন। আপনি খুনি শেখ হাসিনার দোসর। আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আপনার পদত্যাগ দাবি করছি। অন্যথায় আন্দোলন চলবে। আগামীকাল সকালে এসে যেন আমরা শুনতে পাই আপনি পদত্যাগ করেছেন। আপনার লজ্জা থাকলে আপনি পদত্যাগ করবেন।

ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ উসমান হাদি বরেন, ‘রাষ্ট্রপতিকে কোনো সময় দেব না, দ্রুত পদত্যাগ করতে হবে। পদত্যাগ না করা পর্যন্ত বঙ্গভবনের সামনে আমরা রাতযাপন করব।’

বঙ্গভবন এলাকার সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার মো. ফারুক হোসেন বলেন, বঙ্গভবন এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য ডিএমপি থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বঙ্গভবন ও আশপাশের এলাকায় বিপুল সংখ্যক পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। সাদা পোশাকে গোয়েন্দা পুলিশ সদস্যরাও কাজ করছেন। অপ্রীতিকর কিছু যাতে না ঘটে সে জন্য পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনী ও র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা রয়েছেন।

ঢাবির মধুর ক্যান্টিনে রাষ্ট্রপতির কুশপুতুল দাহ ॥ রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের অপসারণের দাবি জানিয়ে কুশপুতুল দাহ করেছে ছাত্র অধিকার পরিষদের নেতাকর্মীরা। মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে এক সংক্ষিপ্ত সমাবেশ শেষে নেতাকর্মীরা এ কুশপুতুল দাহ করে। এ সময় তার পদত্যাগের দাবিতে বিভিন্ন স্লোগানও দেয় তারা। সংক্ষিপ্ত সমাবেশে ছাত্র অধিকার পরিষদের সভাপতি বিন ইয়ামিন মোল্লা বলেন, শেখ হাসিনার পলাতকের পর রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে সরিয়ে দিতে বলেছিলাম আমরা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলাম, গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিট ধরে রাখতে একটি বিপ্লবী সরকার গঠন করা যেতে পারে। কিন্তু তারা রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের কাছে শপথ গ্রহণ করার মাধ্যমে যে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটির খেসারত এখন দিতে হচ্ছে।

উল্লেখ্য, গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। সম্প্রতি মানবজমিন পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর কাছে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, ‘তিনি শুনেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন, কিন্তু আমার কাছে এ সংক্রান্ত কোনো দালিলিক প্রমাণ বা নথিপত্র নেই।’ এরপর নতুন করে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে। বিক্ষুব্ধ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সমাজ আবারও রাজপথে নেমে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের আল্টিমেটাম ঘোষণা করে।

 

 

এই বিভাগের আরো খবর