মুক্তিযোদ্ধার সনদ বানানোর কথা বলে যুব মহিলা লীগ নেত্রীর অর্থ বানিজ্য

সিংগাইর(মানিকগঞ্জ) প্রতিনিধি : মানিকগঞ্জের সিংগাইরে এক ব্যক্তিকে মুক্তিযোদ্ধার সনদ বানানোর কথা বলে ৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা নেওয়ার অভিযোগ ওঠেছে জেলা যুব মহিলা লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক সালেহা জাহানের বিরুদ্ধে। এ সংক্রান্ত একটি ফোনালাপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফাঁস হওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। সাংগঠনিক ব্যবস্থা না নেয়ায় দলের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। ঘটনা প্রকাশ হওয়ায় ভুক্তভোগী পরিবারকে নানা হুমকি ধামকি দেওয়ারও অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে।

সালেহা জাহান মানিকগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য মমতাজ বেগমের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে এলাকায় পরিচিত। নিজেকে সংসদ সদস্যের মেয়ে পরিচয় দিয়ে এলাকায় দাপিয়ে বেড়ান। তার বাড়ি সিংগাইর উপজেলার ধল্লা লক্ষীপুর গ্রামে । বাবার নাম মৃত গিয়াস উদ্দিন(গাদু)। দীর্ঘ দিন প্রবাসে থাকলেও সংসদ সদস্য মমতাজ বেগমের বাসায় কাজ করতে গিয়ে রাজনীতিতে পদার্পন। তিনি সিংগাইর উপজেলা যুবলীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদকও।

সিংগাইর উপজেলার বায়রা এলাকার ভুক্তভোগী কলেজ শিক্ষার্থী গীতা সরকার বলেন, বাবা গৌর চন্দ্র সরকার একজন বেহালা বাদক। বাংলাদেশ বেতারে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করেন। প্রমাণ হিসেবে তাদের কাছে ক্যাপ্টেন হালিম ও জেলা যুদ্ধকালীন কমান্ডারের সাটিফিকেট রয়েছে। দুঃখের বিষয় তালিকায় তার নাম অন্তর্ভুক্ত হয়নি। এ নিয়ে তার পিতার মনে রয়েছে অনেক কষ্ট । সন্তান হিসেবে বাবার কষ্ট দূর করার জন্য বিভিন্ন দপ্তরে ঘুরেছি তালিকায় নাম তুলতে। কিন্তু সবাই জানান টাকা ছাড়া কিছুই হবে না। যুব মহিলা লীগ নেত্রী সালেহা জাহান আমার পূর্ব পরিচিত। তাকে বিষয়টি জানালে অল্প সময়ের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করতে পারবেন বলে আশ্বস্ত করেন। এ জন্য আমার কাছে ৫ লাখ টাকা দাবি করেন। দু‘দফায় ৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা নেন সালেহা জানান। বাকি টাকা কাজের পর দেওয়ার কথা হয়।

গীতা সরকার আরো বলেন, আমার টিউশনি, বোনের কাছ থেকে ধার করা এবং এনজিও থেকে ঋণ তুলে সালেহাকে টাকা দিয়েছি। ব্যক্তিগত হিসাব নম্বর থেকে সালেহার ব্যাংক হিসাব নম্বরে আরটিজিএসের মাধ্যমে সাড়ে তিন লাখ টাকা দিয়েছি। নগদ দিয়েছি ২০ হাজার টাকা। ব্যাংকে টাকা ট্রান্সফারের রশিদও আছে। কিন্তু দু‘বছর পেরিয়ে গেলেও সালেহা জাহান বাবার নাম মুক্তিযোদ্ধার তালিকাভুক্ত করতে পারেননি। এ কারণে তার কাছে টাকা ফেরত চাই। অনেকদিন ঘুরানোর পর কিছু টাকা ফেরত দিয়েছে। কিন্তু বাকি টাকা ফেরত না দিয়ে উল্টো আমাদের চাপে রেখেছেন তিনি।

গীতা সরকারের এক আত্মীয় বেসরকারি একটি টেলিভিশনে ঢাকায় কর্মরত সাংবাদিক প্রদীপ চৌধুরী সম্প্রতি টাকা চেয়ে যুব মহিলা লীগ নেত্রী সালেহা জাহানকে ফোন করেন। এ সময় সালেহা জাহানকে বলতে শোনা যায় টাকা তো ফেরত দেওয়া হয়েছে। ওই সাংবাদিককে বলতে শোনা যায় আপনি তো ২ লাখ টাকা দিয়েছেন। আরও ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা আছে। তখন সালেহা জাহান বলেন, ওটাও ফেরত দিয়ে দেওয়া হবে। এখন কি হয়েছে বলেন ? পারলে আপনারা করে দেন কাজটা। সাংবাদিকের কথার সূত্র ধরে তাকে আবারো বলতে শোনা যায় ওর সঙ্গে (গীতা সরকার) কথা হয়েছে টাকা ফেরত দেবো তাড়াতাড়ি।

ফাঁস হওয়া ফোনালাপের এ কথোপকথনের অডিও নেট দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। অভিযুক্ত যুব মহিলা লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক সালেহা জাহান টাকা নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তবে তিনি দাবি করেছেন বিষয়টি সমাধান হয়েছে। টাকা ফেরত দেওয়া হয়েছে।

মঙ্গলবার(২৭ সেপ্টেম্বর) দুপুরে গীতা সরকারের সঙ্গে কথা হলে বলেন, সালেহা জাহানের কাছে এখনো আমি ৭০ হাজার টাকা পাবো। কিন্তু দেই দিচ্ছি করে তিনি টাকা ফেরত দিচ্ছেন না। উল্টো আমাদের নানাভাবে হুমকি দিচ্ছেন।

তিনি আরো অভিযোগ করে বলেন, ২২ সেপ্টেম্বর রাত পৌনে ১০টার দিকে সালেহা জাহান ও তার স্বামী সিংগাইর উপজেলা শ্রমিক লীগ সভাপতি নাজিমুল ইসলাম জামাল অজ্ঞাত চার-পাঁচজনকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের বাড়ি আসেন। এ সময় আমাকে নানাভাবে হুমকি-ধামকি দেওয়া হয়। বিষয়টি নিয়ে সাংবাদিকদের কাছে মুখ না খুলতেও ভয় দেখানো হয়। এক পর্যায়ে হাত থেকে ফোন নিয়ে সালেহা জাহান নিজেই আমার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে একটি পোস্ট করেন।

সেখানে তিনি লিখেন- সালেহা জাহান আমার বড় আপু। একজন ভালো মানুষ। তার সঙ্গে আমার নাম জড়িয়ে যারা অপপ্রচারের চেষ্টা করছেন দয়া করে বন্ধ করুন। তা না হলে দুজনকে অনতিবিলম্বে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবো। গীতা সরকার।

গীতা সরকার বলেন, আমার ওয়াল ” ধূূতী কন্যা “থেকে লেখাটি ডিলিট করি। এরপরও তিনি স্ক্রিনশট রেখে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে পাঠাচ্ছেন।

মানিকগঞ্জ জেলা যুব মহিলা লীগের আহ্বায়ক রোমেজা আক্তার খান মাহিন বলেন, যুগ্ম আহ্বায়ক সালেহা জাহানের টাকা নেওয়ার ঘটনা জেনেছি। বিষয়টি কেন্দ্রীয় সভানেত্রীকে জানানো হয়েছে। ঘটনা তদন্ত করে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এদিকে সিংগাইর উপজেলা আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতারা জানিয়েছেন, সালেহা জাহানের বাবার পরিবারের লোকজন বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত। সংসদ সদস্য মমতাজের বাড়িতে গৃহপরিচারিকাার কাজ করতেন। সেখান থেকে এমপির মেয়ে বলে পরিচয় দেন। পরবর্তীতে শ্রমিক লীগ নেতা নাজিমুল ইসলাম জামালকে বিয়ে করে পৌর সদরের বসবাস করছেন। এমপি মমতাজের মেয়ে-জামাই পরিচয় দিয়ে সালেহা-জামাল দম্পতি বিভিন্ন দফতরে তদবিরসহ পদ বাণিজ্যে করতেও দ্বিধা করছেন না। এদের বিতর্কিত কর্মকান্ডে আওয়ামীলীগের অনেক নেতাকর্মী ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অন্তর্ভুক্তির জন্য একজন নেত্রীর টাকা নেওয়া একটি জঘন্যতম ও নিন্দনীয় কাজ বলেও তারা জানান। অবিলম্বে সালেহা জাহানের এমন কর্মকান্ডের জন্য দল থেকে বহিস্কারসহ আইনের আওতায় আনার জোর দাবি জানান।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক শারমিন সুলতানা লিলি বলেন,বিষয়টি খতিয়ে দেখে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এই বিভাগের আরো খবর