সময়ের চিত্র ডেস্ক:
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার থেকে শুরু করে সরকার পতনের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের লাগাতার কর্মসূচির সময়টাতে ঘটে যাওয়া সহিংসতাগুলোকে কেন্দ্র করে একের পর এক মামলা হচ্ছে রাজধানীসহ সারা দেশে।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এই দেড় মাসে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপি থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট হাজারো ব্যক্তির নামে অসংখ্য মামলা হয়ে গেছে এরই মধ্যে, যেখানে শুধু হত্যা মামলাই আছে পাঁচ শতাধিক। এরই মধ্যে অভিযোগ উঠেছে, পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটের ফায়দা লুটতে মামলাবাণিজ্যে মেতেছে কয়েকটি চক্র। আর তাদের মূল টার্গেটে পরিণত হচ্ছেন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর কর্ণধাররা। মামলায় আসামি না করার শর্তে ব্যবসায়ীদের কাছে দাবি করা হচ্ছে মোটা অঙ্কের অর্থ। ভুক্তভোগীরা বলছেন, মামলাবাজ ওই চক্রের দাবি না মেটালেই ঠুকে দেওয়া হচ্ছে ‘সিরিজ’ মামলা।
শুধু ব্যবসায়ীই নন, বাদ যাচ্ছেন না সাংবাদিক, তারকারা, এমনকি শিক্ষকরাও। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য এবং পূর্বশত্রুতাকে কেন্দ্র করেও মামলায় ফাঁসানোর অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে এমনও ঘটনা ঘটছে, যেখানে মামলার বাদী ও আসামি কেউই কাউকে চেনেন না।
সম্প্রতি সুপরিচিত একটি ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর কর্ণধারসহ প্রতিষ্ঠানটির কয়েকজন কর্মকর্তার কাছে আইনজীবী পরিচয় দিয়ে তিন কোটি টাকা দাবির অভিযোগ পাওয়া গেছে। টাকা না দিলে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় হতাহতের ঘটনায় হওয়া মামলায় আসামি করা হবে বলে হুমকি দেওয়া হয় বলে জানান ভুক্তভোগীরা।
অভিযোগ অনুযায়ী, আইনজীবী পরিচয় দেওয়া ওই ব্যক্তি বলেন, তাদের সঙ্গে আরও অনেকেই আছেন, যারা খুবই প্রভাবশালী। পুরো অর্থ না দিলে মামলা হয়ে যাবে ব্যবসায়িক গোষ্ঠীটির কর্ণধারের বিরুদ্ধে। হুমকিদাতা ওই ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তাকে একটি বাসায় নিয়ে দেন-দরবার চালিয়ে টাকা আদায়ে ব্যর্থ হন। একপর্যায়ে নির্দিষ্ট অঙ্কের চাঁদা না পেয়ে আদালতের মাধ্যমে রাজধানীর ধানমন্ডি থানায় হত্যা মামলা ঠুকে দেন ওই ব্যক্তি।
এখানেই থেমে থাকেনি ওই ব্যক্তি ও তার সহচররা। কিছুদিন পর আবারও টাকার জন্য চাপ দিয়ে তারা জানান, চাহিদা অনুযায়ী টাকা না দিলে নতুন করে আরও মামলা দেওয়া হবে। সেই টাকা না পেয়ে পল্টন থানায় আরও একটি হত্যা মামলা করা হয় ব্যবসায়িক গোষ্ঠীটির কর্ণধারের বিরুদ্ধে। অথচ এই ব্যবসায়ী কখনো রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্তই ছিলেন না।
একইভাবে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধেও হত্যা মামলা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ মিলছে। এসব বানোয়াট মামলাকে হাতিয়ার বানিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে কয়েকটি চক্র। এ নিয়ে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে জনমনে। বিশেষ করে ব্যবসায়ীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা। অনেকে বাসাবাড়িতেও থাকতে পারছেন না।
সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারাও ঢালাও মামলার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। গণমাধ্যমকে তারা বলেন, প্রতারক চক্র মামলা-বাণিজ্য করছে, তা সত্য। নিরপরাধ ব্যবসায়ী ও লোকজনদের মামলা দিয়ে হয়রানি করছে বলে বেশ কিছু অভিযোগ এসেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘গণ-অভ্যুত্থানে হতাহতের ঘটনায় মামলা নিয়ে প্রতারক চক্র সক্রিয় হয়ে ওঠার গুরুতর অভিযোগ এসেছে। আইনজীবী পরিচয় দিয়ে কেউ কেউ প্রতারক চক্রদের সহযোগিতা করছে। তাছাড়া প্রতারকদের সঙ্গে রাজনৈতিক দলের নেতাদেরও সুসম্পর্ক আছে। সুযোগ পেয়ে তারা মিলেমিশে অপকর্ম চালাচ্ছে। যারা এসব অপকর্ম করছে, তাদের নজরদারির পাশাপাশি আইনের আওতায় আনতে পুলিশের সব ইউনিটপ্রধান ও জেলা পুলিশ সুপারদের বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’
ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার মাইনুল হাসান বলেন, ‘প্রতারকদের বিরুদ্ধে আমরা সতর্ক আছি। একটি চক্র অর্থ না পেয়ে মামলা দিচ্ছে বলে আমাদের কাছে অভিযোগ এসেছে। তাদের বিষয়টি আমরা নজরদারি করছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘কোনো মামলার এজাহারে নাম থাকলেই যে গ্রেপ্তার করতে হবে, আইনে এমন বাধ্যবাধকতা নেই। তদন্ত শেষে তারপর গ্রেপ্তারের বিষয়টি আসে। তদন্তে যাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যাবে না, তাদের নাম মামলা থেকে বাদ দেওয়া হবে।’
এদিকে মামলাবাণিজ্যের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু অসাধু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তার-বাণিজ্যের অভিযোগও পাওয়া গেছে। একাধিক ভুক্তভোগীর দাবি, মামলার আসামিদের ধরতে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এসব অভিযানে নিরপরাধ অনেকে গ্রেপ্তার ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন। তাছাড়া অভিযানের নামে গ্রেপ্তার-বাণিজ্যেরও শিকার হচ্ছেন অনেকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের কাছ থেকে তালিকা সংগ্রহ করার তথ্যও মিলেছে। এই যেমন গত ২৫ আগস্ট ১৭৪ জনের নামে একটি হত্যা মামলা হয় ঢাকার দোহার থানায়। এজাহারে থাকা আসামিদের ঠিকানার সূত্র ধরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজনৈতিক পরিচয় না থাকা সত্ত্বেও রাজধানীর একজন ব্যবসায়ীকে আসামি করা হয়েছে এ মামলায়।
নাম প্রকাশ না করে ওই ব্যবসায়ী বলেন, ‘আমরা সারাজীবন ব্যবসা করি। সে হিসেবে সরকারে যেই থাকে তাদের সঙ্গেই আমাদের মিলেমিশে চলতে হয়। আমরা কোনো রাজনীতি করি না। আমার নামে হত্যা মামলা করা হয়েছে, অথচ ১০ বছরে আমি এলাকাতেই যাইনি।’
মামলাটির বাদী শাজাহান মাঝিকে প্রশ্ন করা হলে জানান, আসামিদের অধিকাংশকেই চেনেন না তিনি। তাহলে মামলাটি কেন করলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক মামলা, তাই সবাইকে চিনিনা, নেতারা যাদের নাম দিয়েছেন, তাদেরই আসামি করা হয়েছে।’
ঢাকার এমন আরও তিনজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীর খোঁজ পাওয়া গেছে, যাদের অভিযোগ, কখনো রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততা ছিলনা তাদের। এমনকি রাজনৈতিক কোনও সভা-সমাবেশে যাননি। অথচ ঢাকার ধানমন্ডি, পল্টন, ভাটারা, গুলশান, উত্তরাসহ কয়েকটি থানায় মামলা করা হয়েছে তাদের নামে।
মামলা করার আগে মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করা হয়েছিল বলে দাবি ওই ব্যবসায়ীদের। তারা বলছেন, চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানানোর কারণেই মামলা ঠুকে দেওয়া হয়েছে। এখন মামলা থেকে নাম প্রত্যাহারের জন্য আবারও অর্থ দাবি করা হচ্ছে।
এদিকে এ ধরনের প্রশ্নবিদ্ধ মামলা প্রকৃত ভুক্তভোগীদের সঠিক বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে নেতিবাচক ভূমিকা এবং প্রকৃত অপরাধীদের বিচারের বাইরে রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে বলে মনে করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেডআই খান পান্না।
তিনি বলেন, যখন ঢাকার ঘটনায় রাজশাহী, রংপুর আর লালমনিরহাট থেকে ১০০-১৫০ মানুষ আসামি হবে, তখন খুব সহজেই অনুমান করা যায় এগুলো বানোয়াট মামলা। এগুলো শুধু হেনস্তার জন্য করা হয়েছে।
জ্যেষ্ঠ এ আইনজীবী বলেন, রংপুর থেকে ১০০ জন মানুষ ঢাকায় এসে একজনকে খুন করবে না। যেখানে লোক মারা গেছে পুলিশের গুলিতে। এগুলো স্ক্রিপ্টেড (সাজানো)। কেউ একজন লিখে দিচ্ছে, সেগুলো থানায় থানায় চলছে। ব্যবসায়ীরাও হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এক নম্বর আসামি শেখ হাসিনা, দুই নম্বর আসামি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং এরপর অমুক এলাকার ২০০ লোক! এগুলো কিছু হলো! এ ধরনের মামলাগুলো করাই হয় প্রকৃত অপরাধীদের বাঁচিয়ে দেওয়ার জন্য।
হেনস্তার উদ্দেশ্যে করা এ ধরনের মামলার ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা কী পদক্ষেপ নিতে পারেন, সে প্রশ্নে জেডআই খান বলেন, আমাকে এভাবে হেনস্তা করার জন্য কেউ মামলায় আসামি করলে, আমি তাদের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ চেয়ে মানহানি মামলা করতাম।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে আর কখনও সহিংসতার ঘটনায় এত কম সময়ে এতসংখ্যক মামলা হয়নি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে সংঘটিত গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের নামে একের পর এক মামলা হচ্ছে বিভিন্ন থানায়। দেড় মাসেও শেষ হওয়ার নাম নেই ঢালাও মামলার এই সিলসিলা।
গত ৫ আগস্ট থেকে ২৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঢাকাসহ সারা দেশে পাঁচশোরও বেশি হত্যা মামলা হয়েছে। এসব মামলার বেশিরভাগের এজাহার একই ধরনের। প্রথম ১০ থেকে ২০ জন আসামি আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাসহ প্রভাবশালী পুলিশ কর্মকর্তারা। মামলায় আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী-অঙ্গসংগঠনের থানা, জেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাকর্মীদেরও আসামি করা হচ্ছে। মাঝে ঢুকে যাচ্ছে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতাহীন ব্যক্তিদের নামও। যেখানে আবার অনেক মামলায় আসামিকে চেনেন না বাদী। আসামিও বাদীর নাম শোনেননি কখনো। ঢালাও মামলার সমালোচনায় বাড়তি মাত্রা যোগ করছে বিষয়টি। -সূত্র: আরটিভি।