
সময়ের চিত্র ডেস্ক: দুই দিনের সফরে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ঢাকায় পৌঁছার পর তাকে লালগালিচা সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে।
রবিবার রাত আটটা ১০ মিনিটে নয়াদিল্লি থেকে তাকে বহনকারী বিমানটি ঢাকায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে।
বিমানবন্দরে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টকে তোপধ্বনির মাধ্যমে স্বাগত জানানো হয়। এর পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে অভ্যর্থনা জানান। বিমানবন্দরেই ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টকে গার্ড অব অনার এবং লালগালিচা সংবর্ধনা দেয় সশস্ত্র বাহিনীর একটি দল। এ সময় উভয় দেশের জাতীয় সংগীত বাজানো হয়। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট গার্ড পরিদর্শন করেন।
ম্যাক্রোঁর আসার মধ্য দিয়ে ৩৩ বছর পর ফরাসি কোনো প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সফর করছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে তিনি জি-২০ সম্মেলন থেকে দেশে ফেরার পথে ঢাকা সফর করছেন। সোমবার রাতে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে একটি বিশেষ ভিভিআইপি ফ্লাইটযোগে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ঢাকায় নামলে তাকে স্বাগত জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনা এ সময় ফরাসি প্রেসিডেন্টকে ফুলের তোড়া দিয়ে শুভেচ্ছা জানান। বিমানবন্দরে লালগালিচাসহ উষ্ণ সংবর্ধনা দিয়ে মোটর শোভাযাত্রাসহকারে ফরাসি প্রেসিডেন্টকে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে নিয়ে যাওয়া হয়। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে রাত নয়টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে নৈশভোজ সভায় অংশ নেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট। নৈশভোজের পাশাপাশি সেখানে আয়োজিত এক মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করেন তিনি। নৈশভোজের পর তিনি ধানমন্ডি লেক ও ব্রিজ হেঁটে ভ্রমণ করেন। এর পর তিনি ‘জলের গানের’ লিড ভোকালিস্ট রাহুল আনন্দের স্টুডিও পরিদর্শন করেন। সেখানে স্টুডিওতে তিনি রাহুল আনন্দের সঙ্গে আড্ডার ফাঁকে গান শোনেন। রাহুল আনন্দ ছাড়াও ওই সময়ে ব্যান্ডটির অন্যান্য সদস্য আসফিকা রহমান, কামরুজ্জামান স্বাধীন ও আফরোজা হোসেন সারা উপস্থিত ছিলেন। প্রায় ৪০ মিনিট রাহুল আনন্দের স্টুডিওতে অবস্থানের পর ম্যাক্রোঁ রাত যাপনের জন্য হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে চলে আসেন।
সফরের দ্বিতীয় দিন আজ সোমবার সকালে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘরে বাংলাদেশের জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। শুরুতে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও দর্শক বইয়ে স্বাক্ষর করবেন তিনি। এর পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ম্যাক্রোঁর শীর্ষ বৈঠকের কথা রয়েছে। সেখানে বেশ কয়েকটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সইয়ের কথা। সবশেষে যৌথ প্রেস ব্রিফিংয়ে অংশ নেবেন দুই নেতা। সংবাদ ব্রিফিং শেষে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রান্স দূতাবাসের আয়োজনে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। এই সময়ে ফরাসি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে অন্যান্যের মধ্যে থাকবেন দেশটির ইউরোপ এবং পররাষ্ট্র বিষয়কমন্ত্রী ক্যাথরিন কলোনা। সফর শেষে বিমানবন্দরে ফরাসি প্রেসিডেন্টকে বিদায় জানাবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন।
এর আগে ১৯৯০ সালে ফ্রান্সের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া মিতেরাঁ ঢাকা সফর করেন। ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর ঢাকা সফরে বাণিজ্যিক, প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক বিষয় প্রাধান্য পেলেও সময় ও ভূরাজনৈতিক কারণে এটিকে ‘অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ’ হিসেবে মনে করছেন কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। বিশ্লেষকদের মতে, একদিকে এই সফরের মাধ্যমে ইউরোপের একটি শক্তিশালী দেশের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক স্থাপনের যেমন একটি সম্ভাবনা তৈরি হবে, অন্যদিকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক দৃঢ় করার মাধ্যমে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সুবিধা আদায়ের সুযোগ তৈরি হতে পারে।
দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় যা থাকবে ॥ ২০২১ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফ্রান্স সফরকালে যৌথ বিবৃতিতে সম্পর্ক উন্নীত করার বিষয়টি উল্লেখ ছিল। এবারের সফরে কৌশলগত নানা উপাদান আছে। কিছু বিষয়ে অগ্রগতি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এয়ারবাস থেকে একটি স্যাটেলাইট কেনার প্রস্তাবেও সাড়া দিতে পারে বাংলাদেশ এবং এ বিষয়ে একটি চুক্তিও হতে পারে। অন্যদিকে ফ্রান্সের সাহায্য সংস্থা এএফডি থেকে ২০ কোটি ডলার সহায়তা পাওয়ার বিষয়ে সমঝোতা স্মারক সই হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
অ্যারোনটিকস খাতে ফ্রান্সের সঙ্গে কাজ করার আগ্রহ রয়েছে বাংলাদেশের এবং এয়ারবাস থেকে ১০টি বিমান ক্রয় করা নিয়েও দৃঢ় প্রতিশ্রুতি থাকতে পারে। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে জোরালো সহায়তার বিষয়ে ফ্রান্সকে অনুরোধ করবে বাংলাদেশ। পাশাপাশি ইন্দো-প্যাসিফিকে সহযোগিতা জোরদারের বিষয়েও আলোচনা হতে পারে দুই নেতার। জলবায়ু পরিবর্তন, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং বাংলাদেশীদের স্কলারশিপসহ অন্যান্য বিষয় নিয়েও আলোচনা হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের চুক্তি হচ্ছে ॥ ম্যাক্রোঁর সফরে মহাকাশে আরও একটি নতুন স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের চুক্তি সই হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় বাংলাদেশ ইতোপূর্বে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করেছে। ফ্রান্সের সহায়তায় এবার যে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করা হবে তার নাম বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২। এটি একটি ‘আর্থ অবজারভেটরি’ ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র। এর মাধ্যমে পৃথিবী তথা বাংলাদেশের স্থলভাগ ও জলভাগ পর্যবেক্ষণ করা হবে।
পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন, অনেকদিন ধরেই ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফরে আসার কথা হচ্ছে। কিন্তু সময় ও সুযোগের অভাবে তিনি আসতে পারেননি। এখন ভারতে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে যোগদানের সুযোগে আসছেন। ফরাসি প্রেসিডেন্টের সফরকালে বড় কোনো চুক্তি হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণে ফ্রান্সের সহায়তার লক্ষ্যে একটি সমঝোতা স্মারক সই হতে পারে। তিনি বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আর কিছুই বলেননি।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের প্রধান ড. শাহজাহান মাহমুদ বৃহস্পতিবার বলেন, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ হলো একটি আর্থ অবজারভেটরি স্যাটেলাইট। এর মাধ্যমে পৃথিবীটা দেখা যাবে। ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রটি পৃথিবীর ছবি বাংলাদেশে পাঠাবে। বাংলাদেশে কৃষি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে করণীয় অনেক কিছু জানা যাবে। পাশাপাশি, বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা চিহ্নিত হওয়ায় আমাদের সমুদ্র অঞ্চল বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে সমুদ্র অঞ্চলে নজরদারি বাড়ানো সম্ভব হবে। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় কেউ অনধিকার প্রবেশ কিংবা কোনো অপতৎপরতা চালাচ্ছে কিনা সেটাও এই স্যাটেলাইটের মাধ্যমে জানা যাবে।
বাংলাদেশের করণীয় ॥ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থান এখন আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় ভালো এবং এর প্রবৃদ্ধির হার ঊর্ধ্বমুখী। ফলে বিভিন্ন দেশ এখানে বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়াতে চায়।
বাংলাদেশ-ফ্রান্স দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সূচনা হয় ১৯৭২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারিতে। ওইদিন ফ্রান্স সরকার সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। এর পর ওই বছরের ১৭ মার্চে প্যারিসে বাংলাদেশ দূতাবাস স্থাপনের মধ্য দিয়ে দুদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। তবে বাঙালির সঙ্গে ফরাসিদের সম্পর্কের সূচনা এখানেই নয় বরং আরও পুরোনো। সতেরো শতকে ফরাসি বণিকদের তৎকালীন বাংলায় আগমনের মধ্য দিয়ে দুটি জাতির সম্পর্কের সূচনা হয়।
গত ৫০ বছরে দুই দেশের মধ্যে বেশ কিছু উচ্চ পর্যায়ের রাষ্ট্রীয় সফর হয়েছে। ১৯৮৯ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এরশাদ প্যারিসে যান। পরের বছর ১৯৯০ সালে ফরাসি প্রেসিডেন্ট মিতেরাঁ বাংলাদেশে আসেন। এছাড়া বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৯ এবং ২০১১ সালের নভেম্বরে প্যারিসে গিয়েছিলেন রাষ্ট্রীয় সফরে।
রাষ্ট্রীয় সফরের মধ্য দিয়ে দুই দেশের সহযোগিতার পরিমাণ বেড়েছে। ১৯৮০ ও ৯০-এর দশকে সাংস্কৃতিক সহযোগিতা চুক্তিসহ (১৯৮৭) বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়। এছাড়া রোহিঙ্গা সমস্যা নিরসনেও ফ্রান্সের সহযোগিতা পেয়েছে বাংলাদেশ।
রাজনৈতিক সম্পর্কের পাশাপাশি একই সময়ে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যও বৃদ্ধি পেয়েছে উত্তরোত্তর। ২০২২-২৩ অর্থবছরে, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৩০৫ কোটি মার্কিন ডলার। যার মধ্যে ফ্রান্সে বাংলাদেশের রপ্তানি ছিল ৩২৯ কোটি মার্কিন ডলার ও এবং আমদানি ছিল ২১ কোটি মার্কিন ডলার। ফ্রান্সে বাংলাদেশ মূলত তৈরি পোশাক রপ্তানি করে থাকে এবং বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি আমদানি করে থাকে।
বাণিজ্যিক সম্পর্কের পাশাপাশি বাংলাদেশের উন্নয়নে ফ্রান্সের সহযোগিতাও রয়েছে। ১৯৯০ সালে প্রেসিডেন্ট মিতেরাঁর বাংলাদেশে আগমনের মধ্য দিয়ে এই সহযোগিতার সূচনা হয়। সেই সফরে, ফ্রান্স বাংলাদেশে বন্যা নিয়ন্ত্রণে বাঁধ প্রকল্পে সাহায্য করে। বর্তমানে বাংলাদেশে পানি শোধনাগার, পরিবেশ প্রকল্পসহ বেশ কটি ফরাসি প্রকল্প ও যৌথ ব্যবসা রয়েছে।
অর্থনৈতিক সহায়তার পাশাপাশি, ফ্রান্স থেকে বাংলাদেশ প্রযুক্তি সহায়তাও পেয়েছে। বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১ নির্মাণ করে ফরাসি প্রযুক্তি কোম্পানি থেলস। এবার বঙ্গবন্ধু-২ চুক্তি হবে দেশটির সঙ্গে। মহামারি মোকাবিলাতেও ফ্রান্স বাংলাদেশে সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছে। মহামারি মোকাবিলায় ফ্রান্স বাংলাদেশকে ১৫০ মিলিয়ন ইউরো ঋণ দিয়েছে এবং এ পর্যন্ত প্রায় ৫.৩৮ মিলিয়ন ডোজ ভ্যাকসিন সহায়তা দিয়েছে যা ভবিষ্যতে আরও বাড়তে পারে।
বিশ্বায়নের এই যুগে বিগত ৫০ বছর ধরে রাষ্ট্র দুটির মধ্যে আন্তঃসাংস্কৃতিক সম্পর্ক বা ‘ক্রস কালচার’ রিলেশনও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৯৮৭ সালের সাংস্কৃতিক সহায়তা চুক্তির পর থেকে এই সম্পর্ক জোরদার হচ্ছে উত্তরোত্তর। ধীরে ধীরে ফরাসি ‘সফট পাওয়ার’-এর প্রভাব দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের সমাজে। ফরাসি ভাষারপ্রসারের জন্য আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ কাজ করে যাচ্ছে।