দুর্যোগ মোকাবিলায় সচেতন হতে হবে

দুর্যোগ শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ Disaster। এটি গ্রিক শব্দ Dis এবং Aster এর সমন্বয়ে গঠিত। Dis অর্থ মন্দ বা খারাপ এবং Aster অর্থ তারা। গ্রিক জ্যোতির্বিদগণ মনে করতেন, আকাশে কোনো তারা খারাপ অবস্থানে থাকলে খারাপ ঘটনা ঘটবে। সুতরাং উৎপত্তিগতভাবে দুর্যোগ বলতে এমন একটি অবস্থা বুঝায় যা মানুষকে মন্দ বা অকল্যাণকর পরিস্থিতির সম্মুখীন করে। দুর্যোগকে বিভিন্ন জন বিভিন্নভাবে সঙ্গায়িত করেছেন। দুর্যোগ হল এমন এক প্রাকৃতিক বা মনুষ্য সৃষ্ট ঘটনা যা পরিবেশের ভারসাম্য অবস্থার বিচ্যুতি ঘটিয়ে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে সাময়িকভাবে ব্যাহত করে থাকে। আবার কেউ কেউ মনে করেন এটি এমন একটি বিপর্যয় যখন কোনো নির্দিষ্ট এলাকার জনগণের বেশির ভাগ মানুষকে বিপদাপন্ন করে তুলে এবং তাদের নিজস্ব মোকাবিলা ক্ষমতার বাইরে চলে যায় তখন তাকে দুর্যোগ বলে। এসব দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে মানুষকে অনেক মূল্য দিতে হয়। দুর্যোগ কখনো হঠাৎ সংঘটিত হয় আবার কখনোবা এক বা একাধিক ঘটনা ধীরে ধীরে দুর্যোগ সৃষ্টি করতে পারে। আবার অনেক সময় একটি দুর্যোগ একাধিক দুর্যোগের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। যেমন- ভূমিকম্প থেকে সুনামি হতে পারে। আবার সুনামি থেকে জলোচ্ছাস এবং জলোচ্ছাস থেকে উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা হতে পারে।

পৃথিবীব্যাপী যে সকল দুর্যোগ সংঘটিত হয় সেগুলোকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং মানবসৃষ্ট দুর্যোগ। প্রাকৃতিক কারণে যে সকল দুর্যোগ সৃষ্টি হয়, সেগুলোকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ(Natural Disaster) বলে। এ ধরনের দুর্যোগের মধ্যে রয়েছে ভূমিকম্প, অগ্ন্যুৎপাত, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা, নদীভাঙন, লবণাক্ততা, তুষারপাত ইত্যাদি। মানবসৃষ্ট দুর্যোগ(Man-made Disaster) মানুষের অবহেলা, ভূলভ্রান্তি বা কোনো বিশেষ কাজের ফলে সৃষ্ট অর্থাৎ এ ধরনের দুর্যোগ মানুষের কর্মকান্ডের ফলে সৃষ্টি হয়। যুদ্ধ, পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ, রাসায়নিক দূষণ, খাদ্যে কীটনাশক ব্যবহার, অপরিকল্পিত ও ত্রুটিপূর্ণ স্থাপনা নির্মাণ ইত্যাদি মানবসৃষ্ট দুর্যোগের অন্তর্ভুক্ত।দুর্যোগ দুই ধরনের হতে পারে। ধীর গতিসম্পন্ন দুর্যোগ এবং দ্রুত গতিসম্পন্ন দুর্যোগ। ধীর গতিসম্পন্ন দুর্যোগ(Slow Onest Disaster) হলো এমন একটি অবস্থা, যা মানুষের খাদ্য ও জীবিকানির্বাহের পণ্যসামগ্রী সংগ্রহের প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করে। যেমন- খরা, শস্যহানি, কৃষিক্ষেতে পোকামাকড়ের আক্রমণ ইত্যাদি। এ ধরনের দুর্যোগ সহজেই চিহ্নিত করা যায় বলে তা প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনা যায়।দ্রুত গতিসম্পন্ন দুর্যোগ (Rapid Disaster) আকস্মিক ঘটে থাকে বলে তা সহজে প্রতিরোধ করা যায় না। দ্রুত গতিসম্পন্ন দুর্যোগের ফলে মানুষ তাৎক্ষণিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং জীবন ও সম্পদহানি ঘটে। যেমন ভূমিকম্প, অগ্ন্যুৎপাত ইত্যাদি।

আমাদের দেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর দুর্যোগ সংক্রান্ত কার্যক্রমের সমন্বয় সাধন, তথ্য সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনা, গবেষণা কর্ম পরিচালনা, গণসচেতনতা বৃদ্ধি, স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে দুর্যোগ পূর্ব প্রস্তুতি এবং মোকাবেলায় কাজ করে । দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে যে কোনো প্রলয়ংকরী দুর্যোগ মোকাবেলায় একটি জরুরি সাড়া প্রদান পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করা সরকারের অন্যতম লক্ষ্য। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম সুচারুভাবে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে জাতীয় পর্যায়ে নীতি নির্ধারণ ও সমন্বয়ের লক্ষ্যে জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাউন্সিল, আন্তঃমন্ত্রণালয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সমন্বয় কমিটি এবং জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা কমিটি রয়েছে। স্থানীয়ভাবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটি রয়েছে। এসব কমিটির মধ্যে রয়েছে জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি, উপজেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি, ইউনিয়ন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি প্রভৃতি। এসব কমিটি দুর্যোগ পূর্ববর্তী এবং দুর্যোগ পরবর্তী কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। সরকার দুর্যোগ মোকাবেলায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সদস্যগণকে প্রশিক্ষণ প্রদান করে থাকে। যেমন- পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর এবং বিভিন্ন এনজিওর সহযোগিতায় জেলায় জেলায় দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসের ওপর প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। এছাড়া অন্যান্য প্রতিষ্ঠান, সংস্থা, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বিভিন্ন পর্যায়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করে থাকে। দুর্যোগ পূর্ববর্তী সতর্কীকরণের জন্য মোবাইল ফোনের মাধ্যমে দুর্যোগ বার্তা প্রচার, এসএমএস, ইন্টারেকটিভ ভয়েস রেসপন্স, কমিউনিটি রেডিও, উপকূলীয় অঞ্চলে পকেট রেডিও ইত্যাদি কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়।

আমাদের দেশে প্রতি বছর বজ্রপাতে অনেক মানুষ মারা যায়। অথচ একটু সতর্ক হলেই এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। এ জন্য সবাইকে সচেতন হতে হবে। এপ্রিল-জুন মাসে বজ্রবৃষ্টি বেশি হয়; বজ্রপাতের সময়সীমা সাধারণত ৩০-৪৫ মিনিট স্থায়ী হয়। এ সময়টুকু ঘরে অবস্থান করতে হবে। ঘন কালো মেঘ দেখা দিলে ঘরের বাইরে বের হওয়া যাবে না। অতি জরুরি প্রয়োজনে রবারের জুতা পরে বাইরে যাওয়া যেতে পারে,তবে না যাওয়াই উত্তম। বজ্রপাতের সময় খোলা জায়গা, খোলা মাঠ অথবা উঁচু স্থানে থাকা যাবে না। বজ্রপাতের সময় ধানক্ষেত বা খোলা মাঠে থাকলে তাড়াতাড়ি পায়ের আঙ্গুলের ওপর ভর দিয়ে এবং কানে আঙ্গুল দিয়ে মাথা নিচু করে বসে থাকতে হবে। যত দ্রুত সম্ভব দালান বা কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নিতে হবে। টিনের চালা যথাসম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে। উঁচু গাছপালা ও বৈদ্যুতিক খুঁটি ও তার বা ধাতব খুটি, মোবাইল টাওয়ার ইত্যাদি থেকে দূরে থাকতে হবে। কালো মেঘ দেখা দিলে নদী, পুকুর, ডোবা বা জলাশয় থেকে দূরে থাকতে হবে। বজ্রপাতের সময় গাড়ীর ভেতর অবস্থান করলে, গাড়ির ধাতব অংশের সাথে শরীরের সংযোগ ঘটানো যাবে না; সম্ভব হলে গাড়ীটি নিয়ে কোনো কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নিতে হবে। বজ্রপাতের সময় বাড়িতে থাকলে জানালার কাছাকাছি ও বারান্দায় থাকা যাবে না। জানালা বন্ধ রাখতে হবে এবং ঘরের ভিতরে বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম থেকে দূরে থাকতে হবে। বজ্রপাতের সময় মোবাইল, ল্যাপটপ, কম্পিউটার, ল্যান্ডফোন, টিভি, ফ্রিজসহ সকল বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম বন্ধ রাখতে হবে। বজ্রপাতের সময় ধাতব হাতলযুক্ত ছাতা ব্যবহার করা যাবে না। বজ্রপাতের সময় ছাউনি বিহীন নৌকায় মাছ ধরতে যাওয়া যাবে না, তবে এ সময় সমুদ্র বা নদীতে থাকলে মাছ ধরা বন্ধ রেখে নৌকার ছাউনির নিচে অবস্থান করতে হবে। বজ্রপাত ও ঝড়ের সময় বাড়ির ধাতব কল, সিঁড়ির ধাতব রেলিং, পাইপ ইত্যাদি স্পর্শ করা যাবে না। প্রতিটি বিল্ডিং-এ বজ্র নিরোধক দন্ড স্থাপন নিশ্চিত করতে হবে। খোলাস্থানে অনেকে একত্রে থাকাকালীন বজ্রপাত শুরু হলে প্রত্যেকে ৫০ থেকে ১০০ ফুট দুরে দুরে সরে যেতে হবে। বজ্রপাতে কেউ আহত হলে বৈদ্যুতিক শকে আহতদের মতো করেই চিকিৎসা করতে হবে। প্রয়োজনে দ্রুত চিকিৎসককে ডাকতে হবে বা হাসপাতালে নিতে হবে। বজ্র আহত ব্যক্তির শাস-প্রশ্বাস ও হ্রদ স্পন্দন ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

আমাদের দেশে প্রতি বছর বন্যায় অনেক সম্পদ নষ্ট হয়। অথচ একটু সতর্ক হলেই এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব।বন্যা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য যথা সম্ভব উঁচু জায়গায় বাড়ি তৈরি করতে হবে। বাড়ি নিচু থাকলে মাটি কেটে ভিটা উঁচু করতে হবে। বাড়ির চারপাশে ফলজ ও বনজ গাছ লাগাতে হবে। বাড়ির চারপাশে ঢেউ প্রতিরোধ করার জন্য ঢোলকলমি, কাশিয়া, দুর্বাঘাস ও ভাঙ্গন প্রতিরোরাধক গাছ লাগাতে হবে। বন্যার অগে ঘরের বেড়া ও চালা শক্ত মজবুত করতে হবে। বন্যার জন্য ঘরে অন্যান্য খাবারের সাথে শুকনা খাবার রাখতে হবে। পানি বিসুদ্ধকরণ ট্যাবলেট সংগ্রহে রাখতে হবে।

ভূমিকম্প একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ভূমিকম্পের বিষয়ে আমাদের সচেতন হতে হবে। ভূকম্পন অনুভূত হলে আতঙ্কিত হওয়া যাবে না। ভূকম্পনের সময় বিছানায় থাকলে বালিশ দিয়ে মাথা ঢেকে টেবিল, ডেস্ক বা শক্ত কোন আসবাবপত্রের নিচে আশ্রয় নিতে হবে। রান্না ঘরে থাকলে গ্যাসের চুলা বন্ধ করে দ্রুত বেরিয়ে আসতে হবে। বিম, কলাম ও পিলার ঘেষে আশ্রয় নিতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অবস্থানকালে স্কুল ব্যাগ মাথায় দিয়ে শক্ত বেঞ্চ অথবা শক্ত টেবিলের নিচে আশ্রয় নিতে হবে। ঘরের বাইরে থাকলে গাছ, উঁচু বাড়ি, বৈদ্যুতিক খুঁটি থেকে দুরে খোলাস্থানে আশ্রয় নিতে হবে। গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি, হাসপাতাল, মার্কেট ও সিনেমা হলে থাকলে বের হওয়ার জন্য দরজার সামনে কিংবা ধাক্কাধাক্কি না করে দুহাতে মাথা ঢেকে বসে পড়তে হবে। ভাংগা দেয়ালের নিচে চাপা পড়লে বেশি নড়া চড়ার করা যাবে না। কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে রাখতে হবে যাতে ধুলা বালি শ্বাস নালিতে না ঢোকে। একবার কম্পন হওয়ার পর আবারও কম্পন হতে পারে। তাই সুযোগ বুঝে বের হয়ে খালি জায়গায় আশ্রয় নিতে হবে। উপর তলায় থাকলে কম্পন বা ঝাঁকুনি না থামা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে; তাড়াহুড়ো করে লাফ বা লিফট ব্যবহার করে নামা যাবে না। কম্পন বা ঝাঁকুনি থামলে সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে খোলা আকাশের নিচে অবস্থান নিতে হবে। গাড়িতে থাকলে ওভার ব্রীজ, ফ্লাইওভার, গাছ ও বৈদ্যুতিক খুটি থেকে দূরে গাড়ি থামাতে হবে। ভূকম্পন থামা পর্যন্ত গাড়ির ভিতের থাকতে হবে। ব্যাটারী চালিত রেডিও, টর্চলাইট, পানি এবং প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জাম বাড়িতে রাখতে হবে। বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মাণ করতে হবে।

প্রাকৃতিক দুর্যোগকে আমরা চিরতরে বন্ধ করতে পারব না। তবে আমরা সচেতন হলে দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতিকে অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।

#

 

 

 

 

 

 

 

 

 

এই বিভাগের আরো খবর