দারিদ্র্য বিমোচনে সরকারি কার্যক্রম

ড. রুমা ইসলাম:

বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচনে সরকারি বেসরকারি প্রচেষ্টা এবং বহুবিধ সামাজিক উদ্যোগের সমন্বিত প্রয়াসে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জিত হয়েছে । সরকারের পরিকল্পিত নীতিকৌশল বাস্তবায়নের ফলস্বরূপ কোভিড-১৯ অভিমারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বৈশ্বিক মন্দার মধ্যেও বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার কমেছে। ‘খানা আয় ও ব্যয় জরিপ ২০২২’ এর প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে বর্তমানে দারিদ্র্যের হার ১৮.৭ শতাংশ এবং অতি দারিদ্র্যের হার ৫.৬ শতাংশ। উল্লেখ্য যে, ২০১৬ সালের খানা আয় ও ব্যয় জরিপ অনুযায়ী দারিদ্র্য এবং অতি দারিদ্র্যের হার ছিল যথাক্রমে ২৪.৩ শতাংশ এবং ১২.৯ শতাংশ। তবে গ্রামঞ্চলের চেয়ে শহরাঞ্চলে দারিদ্র্য হার বেশি হ্রাস পেয়েছে । এ হার পল্লী অঞ্চল ৫.৯ শতাংশ এবং শহরাঞ্চল ৪.২ শতাংশ।

দারিদ্র্য দূরীকরণে লাগসই কৌশলসমূহ যেমন-দারিদ্র্যের ঝুঁকিতে থাকা মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বলয় সম্প্রসারণ, আর্থিক প্রণোদনা, ক্ষুদ্র সঞ্চয়কে উৎসাহ প্রদান, কার্যকর দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস কর্মসূচি ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা করে ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতা বিনির্মাণ, ইত্যাদির প্রয়োগে বাংলাদেশের সাফল্য বিশ্বব্যাপী নজর কেড়েছে। দারিদ্র্য হ্রাসকরণে সরকারের গৃহীত নানা কর্মসূচি বাস্তবায়নে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা ক্ষুদ্রঋণ প্রদানসহ নানাবিধ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। পাশাপাশি, সামাজিক নিরাপত্তা বিধানে সরকার বয়স্ক ভাতা, বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তাদের ভাতা, দুঃস্থ মহিলা ভাতা প্রদানের মাধ্যমে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কল্যাণে পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। সরকার একদিকে অর্থনীতির কাঠামোগত রূপান্তরের লক্ষ্যে নানামুখী উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করে বাস্থবায়ন করছে, অন্যদিকে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের জন্য দারিদ্র্য ও বৈষম্য হ্রাসে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর পরিধি প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি করছে। বৃহৎ উন্নয়ন কর্মসূচির পাশাপাশি একযোগে পরিচালিত হচ্ছে সমাজের পিছিয়ে পড়া দুঃস্থ, অসহায় এবং ছিন্নমূল মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে নানামুখী কর্মসূচি।

সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- বয়স্ক ভাতা প্রদান কার্যক্রম; বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলা ভাতা কার্যক্রম; অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা কার্যক্রম; প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা উপবৃত্তি প্রদান কার্যক্রম; হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি; বেদে জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি; অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি; প্রতিবন্ধিতা শনাক্তকরণ জরিপ কর্মসূচি; ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর বিকল্প কর্মসংস্থান কর্মসূচি; ক্যান্সার, কিডনী, লিভার সিরোসিস, স্ট্রোকে প্যারালাইজড, জন্মগত হৃদরোগ এবং থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগীর আর্থিক সহায়তা কর্মসূচি এবং চা-শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ১লক্ষ ১৩ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা মোট বাজেটের ১৬.৭৫ শতাংশ এবং জিডিপির ২.৫৫ শতাংশ।

২০২৩-২৪ অর্থবছরে বয়স্ক ভাতাভোগী সংখ্যা ৫৮.০১ লক্ষ , বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলা ভাতাভোগীর সংখ্যা ২৫.৭৫ লক্ষ এবং প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা উপবৃত্তি কর্মসূচির আওতায় উপকারভোগীর সংখ্যা ১ লক্ষ জন। এছাড়াও ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রতিবন্ধী ভাতাভোগীর সংখ্যা ২৩.৬৫ লক্ষ হতে ২৯ লক্ষ জনে উন্নীত করা হয়েছে এবং মাসিক ভাতার পরিমাণ ৭৫০ টাকা হতে ৮৫০ টাকায় উন্নীত করা হয়েছে। বর্তমানে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় শুধুমাত্র এ চারটি কার্যক্রমের উপকারভোগী সর্বমোট ১০৬.৪১ লক্ষ জন, যা পূর্ববর্তী অর্থবছরের মোট উপকারভোগীর তুলনায় শতকরা প্রায় ৩.৪৭ ভাগ বেশী। সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে বর্তমানে ভাতাভোগীদের সুবিধার্থে সকল ব্যক্তিকে ডিজিটাল ব্যবস্থাপনায় জিটুপি পদ্ধতিতে ভাতা প্রদান করা হচ্ছে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ১১৫.৭৪১ লক্ষ জন ভাতাভোগী MFS প্রতিষ্ঠান ‘নগদ’, ‘বিকাশ” এবং এজেন্ট ব্যাংকিং এর মাধ্যমে G2P পদ্ধতিতে ভাতা গ্রহণ করছে।
সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমের আওতায় খাদ্য সহায়তা, কাজের বিনিময়ে খাদ্য, খোলা বাজারে পণ্য বিক্রিসহ নানাবিধ কর্মসূচির পাশাপাশি সরকার নগদ অর্থ সহায়তাও প্রদান করে থাকে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচির আওতায় নগদ অর্থ সহায়তা প্রদান বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ কিছু কর্মকাণ্ডের সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিচে উপস্থাপন করা হলোঃ
বয়স্ক ভাতা কর্মসূচিঃ ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছর হতে এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন শুরু করা হয়। শুরুতে প্রতি ওয়ার্ডের ৫ জন পুরুষ ও ৫ জন মহিলাকে প্রতিমাসে ১০০ টাকা হারে ভাতা প্রদান করা হতো। পর্যায়ক্রমে ভাতাভোগীর সংখ্যা ও ভাতার পরিমাণ বৃদ্ধি করা হয়েছে। সমাজের দরিদ্র ও ঝুঁকিপূর্ণ বয়স্ক ব্যক্তি যাদের বয়স পুরুষের ক্ষেত্রে ৬৫ বছর বা তদুর্দ্ধ এবং মহিলাদের ক্ষেত্রে ৬২ বছর বা তদুর্ধ তারা এ কর্মসূচির আওতায় আসতে পারেন। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এ কর্মসূচিতে ভাতাভোগীর সংখ্যা ৫৮.০১ লক্ষ জন, যারা প্রত্যেকে মাসিক ৬শত টাকা হারে ভাতা পাচ্ছেন।
বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তা দুঃস্থ মহিলা ভাতা কার্যক্রমঃ দরিদ্র, ঝুঁকিপূর্ণ ও অনগ্রসর নারীর সামাজিক সুরক্ষা ও তাদের ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরে ‘বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলা ভাতা’ কর্মসূচি চালু হয়েছে। শুরুতে এ কর্মসূচির আওতায় ৪.০৩ লক্ষ জন নারী মাসিক ১০০ টাকা হারে ভাতা পেতেন। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ভাতাভোগীর সংখ্যা ২৫.৭৫ লক্ষ জন, যারা প্রত্যেকে মাসিক ৫৫০ টাকা হারে ভাতা পাচ্ছেন।

দরিদ্র মায়েদের মাতৃত্বকালীন ভাতাঃ ২০০৭-০৮ অর্থবছরে প্রথমবারের মত মাতৃত্বকালীন ভাতা প্রদান চালু করা হয়। এর আওতায় মূলত পল্লী এলাকার দরিদ্র মায়েদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়ে থাকে। এ কার্যক্রমের আওতায় দরিদ্র গর্ভবতী মহিলাদের ভাতা প্রদানের পাশাপাশি স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বিষয়ক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়ে থাকে। আগে মাসিক ৫০০ টাকা হারে এ ভাতা প্রদান করা হতো। বর্তমানে দরিদ্র মায়েদের মাতৃত্বকালীন মাসিক ভাতা ৮০০ টাকা করা হয়েছে। এছাড়া ভাতা প্রদানের মেয়াদও ২৪ মাস থেকে বৃদ্ধি করে ৩৬ মাস করা হয়েছে।

কর্মজীবী ল্যাকটেটিং মাদার সহায়তা তহবিলঃ ২০১০-১১ অর্থবছর থেকে এ কার্যক্রম শুরু হয়। শহরাঞ্চলে কর্মজীবী দরিদ্র মায়েদের মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্য ও তাদের গর্ভস্থ সন্তান বা নবজাত শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশে সহায়তার উদ্দেশ্যে এই ভাতা প্রদান করা হয়। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর গার্মেন্টস শিল্প এলাকা এবং দেশের সকল সিটি কর্পোরেশন/পৌরসভাকে এই কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত রাখা হয়েছে। ইতঃপূর্বে একজন মা মাসে ৫০০ টাকা করে ২৪ মাস পর্যন্ত এ সহায়তা পেতেন। ২০১৮-১৯ অর্থবছর হতে ভাতার পরিমাণ ও মেয়াদ দুটোই বৃদ্ধি করা হয়েছে। একজন মা মাসে ৮০০ টাকা করে ৩৬ মাস পর্যন্ত এ সহায়তা পান।
মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতাঃ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। ২০২১-২২ অর্থবছর থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ভাতা মাসিক ১২ হাজার টাকা থেকে ২০ হাজার টাকায় উন্নীত করা হয়েছে। খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি ভাতাসহ ১০ হাজার টাকা হারে বছরে ২টি উৎসব ভাতা প্রদান করা হচ্ছে। বর্তমানে বীরশ্রেষ্ঠদের ৩৫,০০০ টাকা, বীর উত্তমদের ২৫,০০০ টাকা এবং বীর বিক্রম ও বীর প্রতীকদের ২০,০০০ টাকা হারে মাসিক সম্মানি প্রদান করা হয়। বর্তমানে দেশের সকল জেলায় সব মুক্তিযোদ্ধাদের G2P পদ্ধতিতে সম্মানী ভাতা প্রদান করা হচ্ছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ভাতা ও উৎসব ভাতার পাশাপাশি ২,০০০ টাকা করে বাংলা নববর্ষ ভাতা দেয়া হচ্ছে। এছাড়াও, সকল জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের জনপ্রতি ৫ হাজার টাকা করে বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে বিশেষ সম্মানী ভাতা প্রদান করা হচ্ছে। শহীদ পরিবার ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা ও সম্মানী ভাতার জন্যে পৃথক কর্মসূচি চালু করা আছে।
অস্বচ্ছল প্রতিবন্ধীদের জন্য ভাতাঃ ২০০৫-০৬ অর্থবছরে চালু করা হয় অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা কর্মসূচি। এ কর্মসূচির আওতায় শুরুতে ১ লাখ ৪ হাজার ১৬৬ জন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে মাসিক ২০০ টাকা হারে ভাতা প্রদান করা হতো । ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২৯ লক্ষ জন উপকারভোগী মাসিক ৮৫০ টাকা হারে ভাতা পাচ্ছেন।
প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা উপবৃত্তিঃ সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ‘প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা উপবৃত্তি কর্মসূচি চালু করা হয়। শুরুতে এ কর্মসূচির আওতায় উপকারভোগীর সংখ্যা ছিল ১২ হাজার ২০৯ জন। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এ কর্মসূচির আওতায় ০১ লক্ষ উপকার ভোগীকে প্রাথমিক স্তরে মাসিক ৯০০ টাকা, মাধ্যমিকও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে ৯৫০ টাকা এবং উচ্চতর স্তরে ০১হাজার ০৩শত টাকা হারে উপবৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে।

বেসরকারি এতিমখানার ক্যাপিটেশন গ্র্যান্টঃ সমাজসেবা অধিদফতর কর্তৃক নিবন্ধীকৃত বেসরকারি এতিমখানায় ন্যূনতম ১০ জন এতিম অবস্থানকৃত প্রতিষ্ঠানে সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ এতিমের লালন পালনের জন্য জনপ্রতি ২ হাজার টাকা হিসেবে ক্যাপিটেশন গ্রান্ট প্রদান করা হয়।
বেদে জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচিঃ ২০১২-১৩ অর্থবছরে পাইলট হিসেবে দেশের ৭টি জেলা যথাক্রমে ঢাকা, চট্টগ্রাম, দিনাজপুর, পটুয়াখালী, যশোর, নওগাঁ ও হবিগঞ্জ জেলায় এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন শুরু হয়েছিলো। বর্তমানে কর্মসূচি সম্প্রসারণ করে মোট ৬৪ জেলায় এ কার্যক্রম বাস্তবায়িত হচ্ছে।

বর্তমান সরকারের মূল লক্ষ্য হলো সমাজে পিছিয়ে পড়া সকলকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া।আর এর মাধ্যমেই বৈশম্যহীন,ক্ষুধা দারিদ্যমুক্ত উন্নত বাংলাদেশ বির্নিমান সম্ভব হবে।

লেখক: উপ সচিব
পিআইডি ফিচার

এই বিভাগের আরো খবর