জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান ইতিহাসে একটি গৌরবময় ঘটনা

মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন

ছাত্ররা একটি জাতির ভবিষৎ। যে শিশু এখন ন্যায়-নীতি, আদর্শ, মূল্যবোধ, স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে, সেই একদিন হয়ে উঠতে পারে জাতির ভাগ্য পরিবর্তনের কারিগর। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাসে ছাত্র সমাজের ভূমিকা সবচেয়ে অগ্রগন্য। সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের অভ্যূদয়ের ইতিহাসের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে সকল শৃঙ্খল, অন্যায়-অবিচার ও স্বৈরাচারী শাসন থেকে মুক্তির সুতিকাগার হয়ে উঠেছে ছাত্র আন্দোলন। ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার আন্দোলন বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গৌরবময় ঘটনা। ইতিহাসে প্রথম ছাত্র আন্দোলন হয় চিনে,১৬০ খ্রিস্টাব্দে। তাদের এই আন্দোলন সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল। সেই আন্দোলনে ১৭২ জন শিক্ষার্থীকে কারাগারে নিক্ষেপ করে,অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। ১৮৪৮ সালে ফ্রান্সের শিক্ষার্থীরা রাজা ও সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে,তারা তাদের নিজ নিজ দেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে লড়াই করে। ১৯৪৩ সালের ‘হোয়াইট রোজ আন্দোলন’এ মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নাৎসি শাসনের বিরুদ্ধে এক অহিংস প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু করেন। আন্দোলনে জরিত থাকার অভিযোগে ছয়জন প্রধান সদস্যকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে ছাত্র আন্দোলনের এক অন্যতম দৃষ্টান্ত হলো সাতচল্লিশের দেশভাগের পরবর্তী বাংলাদেশের ইতিহাসে ছাত্র আন্দোলনের এক অনন্য দৃষ্টান্ত রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার আন্দোলন। ১৯৫২ সালে ঢাকা শহরের ছাত্ররা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে এ আন্দোলনে নামেন। ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় রাষ্ট্রভাষা বাংলা। ‘বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন’,’ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান’, ‘একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ’ ছাত্ররা মুক্তিবাহিনী গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। স্বাধীনতা পরবর্তী ‘নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন’ ২০১৮ সালের ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন’ এর্ শেষ ২০২৪ সালে ‘ঐতিহাসিক বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা আন্দোলন’।

২০২৪ সালের ১৬ জুলাই বাংলাদেশসহ বিশ্বের ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা। এদিন রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের মেধাবী শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে প্রকাশ্যে পুলিশ গুলি করে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এ পাশবিক ঘটনা দেশ-বিদেশে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। যার ফলে সরকারের ক্ষমতায় থাকার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। আন্দোলনে টর্নেডো গতির সঞ্চার হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে শেখ হাসিনাই একমাত্র কর্তৃত্ববাদী স্বৈরাচারী সরকার প্রধান, যিনি ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন। অবসান হয় সারে পনের বছরের দুঃশাসন। একাত্তরে অন্যায় হয়েছিল এর বিরুদ্ধে বীর বাঙালী রুখে দাড়িয়েছিল। ২০২৪ সালেও অন্যায় হয়েছে এবার আমাদের ছাত্র-জনতা রুখে দাড়িয়েছে। তাদের বুকের তাজা রক্তের বিনিময় এক নতুন বাংলাদেশ দিয়ে গেছে। আমরা যে রাষ্ট্র বা সমাজ নির্মান করেছিলাম আমাদের সন্তানেরা সে সমাজ বা রাষ্ট্র ব্যবস্থা পছন্দ হয়নি। তারা এক নতুন রাষ্ট্র নির্মানে রাস্তায় নেমেছে রুখে দাড়িয়েছে। বড়োরা ন্যায় অন্যায়ে স্থুল ছিলো,তাইতো বচ্চারা আমাদের শিক্ষা দিয়েছে যে আর অন্যায় সহ্য করবেনা। এই শিক্ষার্থীরা আমাদের শেকড়কে নাড়া দিয়েছে।

১৫ বছরে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করে দিয়েছিল তৎকালীন সরকার। আওয়ামী লীগের যে ক্ষমতার ভিত্তি, তার কোনোটাই টেকসই ছিল না। কারণ তারা জনগণ থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন। ”ফলে মানুষের একটা ক্যাটালিস্ট বা স্ফূলিংগের দরকার ছিল। সেটাই শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দিয়ে শুরু হয়েছে। একতরফা বা জালিয়াতির নির্বাচন, বিরোধীদের ও বিরুদ্ধ মত দমন, অনিয়ম আর দুর্নীতি, আমলা আর প্রশাসনের ওপর নির্ভর করে দলটির টিকে থাকা এই পতনের পেছনে মূল কয়েকটি কারণ হিসেবে উঠে আসছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দেলন ও তারুণ্যের চেতনায় দেশে একটি নব শক্তির উত্থান ঘটেছে। সমগ্র জাতি আজ স্বপ্ন দেখছে বৈষম্যহীন ও শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার। বর্তমান তরুণসমাজ জাতিকে একটি সমৃদ্ধ রাষ্ট্র প্রতিষ্টার অঙ্গিকার নিয়ে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার নেতৃত্ব দিচ্ছে । ২০২৪ সালের আমাদের সন্তানদের আত্মত্যাগ ভোলা যায় না। ৭১ এর মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তরসূরি এরা।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা আন্দোলনে সহিংসতায় মোট এক হাজার ৫৮১ জন নিহত হয়েছে (স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় হিসাব মতে নিহতের সংখ্যা ৭০৮ জন )। আন্দোলনের স্বাস্থ্য বিষযয়ক কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির হিসেবে আন্দোলনে ১৪২৩ জন নিহত হয়েছেন। আন্দোলনে আহত হয়েছে প্রায় ৩১ হাজারের বেশি মানুষ।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহতদের যাবতীয় চিকিৎসা ব্যয় সরকার বহন করবে। আন্দোলনে যারা আহত হয়েছেন, সরকারি হাসপাতালে তাদের বিনামূল্যে চিকিৎসাসহ যাবতীয় চিকিৎসা ব্যয় বহন করা হবে।’ একইসঙ্গে আন্দোলনে আহত চিকিৎসধীন ছাত্র জনতার চিকিৎসা সেবা সুনিশ্চিতে দেশের সব সরকারি হাসপাতালে আলাদা স্পেশালাইজড ডেডিকেটেড কেয়ার ইউনিট তৈরি করারও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহিদদের স্মৃতি সংরক্ষণ ও শহিদ পরিবারগুলোকে সহায়তার জন্য গঠন করা হয়েছে ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ফাউন্ডেশনের সভাপতি এবং ফাউন্ডেশনের সাত সদস্যের কার্যনির্বাহী কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- কাজী ওয়াকার আহমদ (কোষাধ্যক্ষ), তথ্য উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম (দপ্তর সম্পাদক) এবং যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজিব ভূঁইয়া, নুরজাহান বেগম ও সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা শারমিন এস মুর্শিদ (কার্যনির্বাহী সদস্য)। এ ফাউন্ডেশনে প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকে ইতোমধ্যে ১০০ কোটি টাকা অনুদান দেওয়া হয়েছে ।

‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’ এর মাধ্যমে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহিদদের পরিবার এবং আহতদের এককালীন ও মাসিক সহায়তা দেওয়া হবে। আন্দোলনে নিহত শহিদদের প্রত্যেক পরিবার প্রাথমিকভাবে ৫ লাখ টাকা এবং আহত প্রত্যেককে এক লাখ টাকা করে দেওয়া হচ্ছে। এছারাও আহতদের চিকিৎসায় যা যা করনীয় সব করবে সরকার। একটি কল্যাণ সংস্থা এতে এক কোটি টাকা অনুদান দিয়েছে। এর মধ্যে ৯১ জন আহত ও একজন শহিদের পরিবারকে প্রায় ৮৫ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। ডিসেম্বর, ২০২৪ এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের নিকট বাজেট সাপোর্টে যুক্ত হবে ৭৫০ মিলিয়ন ইউএসডি,যার একটি বিষয় পলিসি পর্যায়ে বাস্তবায়ন এ মন্ত্রণালয় করছে। আন্দোলনকে কেন্দ্র করে জুলাই থেকে আগস্ট পর্যন্ত ১০৫ জন শিশুর মৃত্যু হয়েছে। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় তাদের পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা দিয়েছে। আন্দোলনে আহত শিক্ষার্থী-জনতাকে মোট ৮২,৭৪,৭৯৮/- টাকার সেবা প্রদান করেছে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। এছারা আহত শিক্ষার্থী-জনতার মধ্যে বিনামূল্যে হুইল চেয়ার ও হিয়ারিং এইড প্রদান করা হবে। জুলাই শহিদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন সাম্প্রতিক ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আহতদের মধ্য থেকে প্রতি সপ্তাহে ২০০ থেকে ৩০০ জনকে সহায়তা প্রদান করবে অন্তবর্তীকালীন সরকার। এছাড়াও জামায়াতে ইসলামী পক্ষ হতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসা ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর পুনর্বাসনে দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে সহায়তা চেয়েছে ।

১৫/১০/২০২৪ হতে ৩১/১০/২০২৪ তারিখের মধ্যে জুলাই অভ্যুত্থানে সকল আহত/নিহত ছাত্র-শ্রমিক-জনতার তথ্যাদি নিজ উদ্যোগে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অনলাইনে এর মাধ্যমে দাখিল করার বিষয়ে কার্যক্রম চলমান রয়েছে । সরকারের পক্ষ হতে ছাত্র আন্দোলনের শহিদদের মধ্যে যদি কারো নাম এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত না হয়, তাহলে শহিদ পরিবারের সদস্য, ওয়ারিশ, প্রতিনিধিদের উপযুক্ত প্রমাণসহ সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক, সিভিল সার্জন,উপজেলা নির্বাহী অফিসার বা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করার জন্য বলা হয়েছে। তৎকালিন সরকার ঘোষিত ৫ আগস্টে চলছিল প্রথম দিনের কারফিউ। এদিন কারফিউ অমান্য করে বেলা ১১ টার পর থেকে সারা দেশের শিক্ষার্থী ও সাধারণ জনগণ শাহবাগে জড়ো হতে থাকে। তারপর শাহবাগ থেকে আন্দোলনকারীরা গণভবনের দিকে পদযাত্রা শুরু করেন। এ সময় শেখ হাসিনা বেলা দুইটার দিকে পদত্যাগ করেন এবং আড়াইটার দিকে বঙ্গভবন থেকে একটি সামরিক হেলিকপ্টার করে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উদ্দেশ্যে দেশ ত্যাগ করেন। এরই মধ্য দিয়ে ১৫ বছরেরও বেশি সময়ের ফ্যাসিবাদি শাসনের অবসান ঘটে।

ছাত্র-জনতা ৬ আগস্ট একটি নতুন বাংলাদেশ বিনীর্মান করে দিয়েছে। এখন ভবিষৎ প্রজন্মের উপযোগি হিসেবে গড়তে হবে দেশকে। আর যেনো দেশে ৫ আগস্ট এর পূর্বের অবস্থা ফিরে না আসে সেই কাজগুলোই করতে হবে। আর যদি সে কাজ না করা হয় ইতিহাস ক্ষমা করবেনা, ইতিহাস যে সুযোগ করে দিয়েছে সেই সুযোগের পরিপূর্ণ কাজ করতে হবে, সুন্দর বাসযোগ্য একটি সত্যিকারের বাংলাদেশের জন্য।

লেখক: সিনিয়র তথ্য অফিসার
পিআইডি ফিচার

এই বিভাগের আরো খবর