ঘন কুয়াশা ও রোদের কারণে বীজতলা নষ্টের আশঙ্কা

আনোয়ার সাঈদ তিতু, কুড়িগ্রাম ।।

দেশের উত্তরাঞ্চলের সীমান্তবর্তী জেলা কুড়িগ্রামে শীতের প্রকোপ সাধারণত বেশিই থাকে। কিন্তু এবারের শীত মৌসুমে আবহাওয়ার বিরূপ আচরণে বিপাকে পড়েছেন কৃষক। তারা বলছেন, ভোর ও সকালে ঘন কুয়াশা ঝরছে; কিন্তু দুপুরে কড়া রোদ। আর বিকেল হতেই পড়ছে ঠান্ডা। এর ফলে ধানের বীজতলা ও শীতকালীন শাকসবজি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কোনো কৃষি কর্মকর্তা মাঠে নেই। এই পরিস্থিতিতে ফসলের যত্ন কেমন হওয়া দরকার, সে বিষয়ে পরামর্শ না পেয়ে দুশ্চিন্তায় তারা।

 

কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর, রাজারহাট, ফুলবাড়ী ও নাগেশ্বরী উপজেলা ঘুরে কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভোর থেকে সকাল ৮-৯টা পর্যন্ত ঘন কুয়াশা ঝরছে। দুপুর না হতেই বাড়ছে রোদের তীব্রতা। এ কারণে বোরো ধানের বীজতলা, সরিষা, বেগুন, লাউ, ফুলকপিসহ শীতকালীন শাকসবজির মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। বীজতলাগুলো পলিথিন দিয়ে রাতে ঢেকে রাখতে হচ্ছে। এর পরও রোদে সেগুলো পচে যাচ্ছে। অন্যদিকে, বেগুন ও লাউয়ের ক্ষেতগুলোতে পরিপক্ব হওয়ার আগেই ফুল ঝরে পড়ছে। পাশাপাশি সরিষা ও ফুলকপির ক্ষেতে আশানুরূপ ফলন দেখা যায়নি।

 

নাগেশ্বরী উপজেলার পায়রাডাঙ্গা গ্রামের সবজি চাষি সামছুল হক বলেন, ‘সারা আইত থেকি বেলা ৯-১০টা পর্যন্ত এত কুয়াশা পড়ে, হামার শাকসবজির বলন্ত (বাড়ন্ত) কমি যাবার নাগছে। লাউয়ের ফুলগল্যা খালি পচি যায়। কৃষি অফিসারের লোকের ঘর হামার এট্টি আইসে না।’

 

রাজারহাট উপজেলার চাকিরপশার ইউনিয়নের চাকিরপশার তালুক গ্রামের নবাব আলী জানান, সকালে ঠান্ডা ও দুপুরে আকস্মিক গরম পড়ছে। এ কারণে তাঁর প্রায় এক একর জমির ধান ক্ষেতে ছত্রাক ও কারেন্ট পোকার আক্রমণ দেখা দিয়েছে।

 

ফুলবাড়ী উপজেলার পশ্চিম ফুলমতি গ্রামের হযরত আলী জানান, ফুলকপি ও বেগুনের গাছ কুঁচকে গেছে। দুপুরে রোদ দেখা গেলেও বিকেলের পর থেকে সূর্যের আলো না থাকায় ওষুধ দিতে পারছেন না। কোনো কৃষি কর্মকর্তার মোবাইল ফোনের নম্বরও নেই যে, যোগাযোগ করে পরামর্শ নেবেন। বাধ্য হয়ে নিজস্ব অভিজ্ঞতা আর অনুমানের ওপর ভর করে সমাধানের পথ খুঁজছেন তাঁর মতো অনেকে।

 

পরিবেশবিদরা বলছেন, প্রতিবছর হিমালয় থেকে আসা ঠান্ডা আবহাওয়ার কারণে আগাম শীত অনুভূত হলেও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঋতুও বদলে যাচ্ছে। ফলে এ বছর দেরিতে শীত পড়ছে কুড়িগ্রামে।

 

আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, গত শনিবার কুড়িগ্রামে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ১৬ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, আর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ২৯ দশমিক ৫ ডিগ্রি। পরদিন রোববার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১৫ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস, সর্বোচ্চ ২৮ দশমিক ৫ ডিগ্রি। সোমবার এ জেলায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ১৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ২৯ ডিগ্রি।

 

জলবায়ু সুবিচার নিয়ে কাজ করা সংগঠন ইয়ুথনেট গ্লোবালের নির্বাহী সমন্বয়ক সোহানুর রহমান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে কুড়িগ্রামের মতো ছোট জেলাগুলোকে প্রতিনিয়ত আকস্মিক প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। কার্বন নিঃসরণ, সিসার ব্যবহার, পলিথিন দূষণ– নানাভাবে প্রকৃতিকে আমরা ধ্বংস করে দিচ্ছি, যার কারণে কুড়িগ্রামে কৃষিক্ষেত্র ব্যাপক ক্ষতির মুখে।

 

রাজারহাট কৃষি আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার (কৃষি ও সিনপটিক) জানায়, গত বছর ও চলতি বছরের তাপমাত্রায় পার্থক্য খুব একটা নেই। তবে বায়ুর চাপ, আর্দ্রতা, গতিবেগ ও মাটির নিচের তাপমাত্রা ইত্যাদি কমার কারণে আবহাওয়াজনিত অনেক পার্থক্য লক্ষ্য করা গেছে।

 

এই পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুবল চন্দ্র সরকার জানান, গত এক বছরে তাপমাত্রার পরিমাপ একই থাকলেও আবহাওয়াজনিত পরিবর্তন ব্যাপকভাবে বেড়েছে। চরাঞ্চলগুলোর জমির মাটির নিচের তাপমাত্রা, বাতাসের গতিবেগ, আর্দ্রতা ও বায়ুর চাপের পরিবর্তন ঘটেছে। আমরা বিভিন্নভাবে এসব পরিমাপ করে দেখেছি, গত বছরের তুলনায় ধান ও সবজি চাষের অনুপযোগী থাকায় কৃষি ক্ষেত্রে ফসলের ক্ষতি হচ্ছে।

 

তিনি আরও বলেন, সকালে খুব কুয়াশা পড়ছে আবার দুপুরে তীব্র রোদ। গত বছরের নভেম্বর মাসে এ সময়টা এমন ছিল না। সে সময় আবহাওয়ার বিভিন্ন উপাদানের পরিমাপগুলো শীতকালীন সবজির অনুকূলে ছিল। বর্তমানে সেটি নেই।

 

তবে নাগেশ্বরী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শাহরিয়ার আলম জানান, এই শীতে ফসলের তেমন কোনো ক্ষতি হবে না। ঘন কুয়াশায় বীজতলার ক্ষতি হয়। কিন্তু এখনও তো কৃষক বীজতলা করেনি যে, ক্ষতি হবে।

 

কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক (শস্য) মো. আসাদুজ্জামান বলেন, বর্তমানে ফসলের কোনো সমস্যা হচ্ছে না। শীতকালে ১০ ডিগ্রির নিচে তাপমাত্রা না কমা পর্যন্ত ফসলের তেমন ক্ষতি হয় না। কৃষকরা কৃষি কর্মকর্তাদের মাঠে পাচ্ছেন না– এ বিষয়ে জানতে চাইলে কোনো জবাব দেননি তিনি।

এই বিভাগের আরো খবর