গণতন্ত্র, সংস্কৃতি এবং শিল্পের সান্নিধ্য: মানবিক সমাজ গঠনে প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও দৃষ্টিভঙ্গি
ড . দিপু সিদ্দিকী
গণতন্ত্র তখনই পরিপূর্ণতা পায় যখন নাগরিকেরা কেবল শিক্ষিতই নয়, বরং মানবিক গুণাবলির অধিকারী হয়। সাধারণভাবে উচ্চশিক্ষার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো জীবন উপভোগ করার মতো শিক্ষা, যা কেবলমাত্র পাঠ্যবইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং জীবন এবং সংস্কৃতির সাথে গভীরভাবে জড়িত। মনুষ্যত্বের উন্মেষে সংস্কৃতি চর্চা ও শিল্পের প্রভাব অপরিসীম। অথচ বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় নির্ভর এবং প্রতি সর্বস্ব শিক্ষাদান অব্যাহত রয়েছে। যেখানে শিক্ষার্থী কিছু সূত্র মুখস্ত করা এবং শিক্ষকের সহায়তায় তত্ত্ব এবং তথ্যে ভরপুর কতগুলো প্রশ্নের উত্তর মুখস্ত করা এবং পরীক্ষায় তা লিখে আসার একটি অদম্য প্রতিযোগিতায় মেতে থাকে সারাটি বছর। এই কষ্টকর এবং আনন্দহীন শিক্ষা মূলত তাকে শিক্ষা বিমুখ করে তোলে। অভিভাবকের চাপে কিংবা ভবিষ্যতে রুটি রুজির হাতিয়ার হিসেবে সে এই প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়। এবং এক্ষেত্রে তারা সফল হয়। আমরা অর্ধশত বছর দেখে আসছি যে বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কিভাবে গাইড বই আর বিসিএস কোচিং সেন্টারের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য কেন্দ্রীয় লাইব্রেরীর সামনে রুটি রুজি জোগাড়ের প্রতিযোগিতায় উন্মত্ত শিক্ষার্থীদের জটলা লেগেই থাকে বছরজুড়ে। লাইব্রেরীর দরজা খোলার অপেক্ষায় তারা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে। একজন আগন্তুক অধ্যয়নের জন্য লাইব্রেরীর সামনে সারিতে দাঁড়িয়ে থাকা শিক্ষার্থীদের দেখে শ্রদ্ধা অবনত হয়। কখনো কখনো সে নিজেকে অপাংন্তেয় মনে করে। আর চিন্তা করতে থাকে সারা দেশের শিক্ষার্থীরা ও যদি নিজ নিজ গৃহে এমন একটি গ্রন্থাগার করা যেত তবে কত শত মেধাবী উদ্ভাবক পন্ডিত তৈরি হতো আমাদের দেশে। একটা সময় বাস্তবতার সঙ্গে যখন লাইব্রেরীর সামনে গাইড বই মুখস্ত কারীদের প্রকৃতচিত্র বিশ্লেষণ করে ফলাফল দেখে তখন হতাশ হওয়া ছাড়া আর কিছুই থাকে না। ভদ্র আগুন্তকের বিশ্বাস আরো প্রগাঢ় হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রথিতযশা অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম এর কলাম পড়ে। এতেই ক্ষ্যান্ত হন না আগন্তক। তিনিও দেশের অন্যান্য শিক্ষাবিদদের সঙ্গে একমত হন শান্তি প্রতিষ্ঠায় বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা অবদান খুবই সামান্য। ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ প্রথম আলো পত্রিকা প্রকাশিত সংবাদটি শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে মানুষের মনে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে গড়ে ওঠা বিশ্বাসের ভিত্তিকে আরো নড়বড়ে করে দেয়। ‘দীর্ঘস্থায়ী শান্তির জন্য শিক্ষা’ শীর্ষক এই আলোচনা সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন,বাংলাদেশে যে উপায়ে শিক্ষা দেওয়া হয় তাতে আদর্শিক শিক্ষার ছায়াপাত সামান্যই। যে শিক্ষায় মুখস্থ করা, পরীক্ষা দেওয়া ও পাস করা এবং পড়াশোনা শেষে চাকরি খোঁজা প্রধান পদ্ধতি হয়ে দাঁড়ায়, তা সমাজে বা দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করতে পারে না।’
(সূত্র: ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪,প্রথম আলো)।
আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবস ২০২৪ উপলক্ষে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে এক আলোচনা সভায় তিনি বলেছিলেন যে , প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা শিক্ষার্থীকে চাকরির অন্বেষণে প্রতিযোগী কিংবা প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে।’দুর্ভাগ্যজনকভাবে শিক্ষাকে সেভাবে রূপান্তর করা হয়েছে। তা সমাজে বা দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করতে পারে না। এই শিক্ষা নিয়ন্ত্রণ করে কোচিং ও নোট বই ব্যবসা। এটি যথাযথভাবে বাজারমুখীও হয় না। তাই এর রূপান্তর প্রয়োজন।’ (সূত্র ৭ই ফেব্রুয়ারি প্রথম আলো ২০২৪) বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপনার অভিজ্ঞতায় আমিও দেখেছি শিক্ষার্থীরা ক্লাসে পরীক্ষার সাজেশন নেয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। শর্টকাট পদ্ধতিতে সনদ সংগ্রহ করা যেন একমাত্র লক্ষ্য। অধ্যাপকের ক্লাস লেকচার যতই জ্ঞানদীপ্ত হোক না কেন তা শিক্ষার্থীদের হৃদয়ঙ্গম হয় না। শিক্ষার্থীদের প্রাণে জ্ঞানের তৃষ্ণা প্রতিনিয়ত কমে যাচ্ছে। তারা ভুলে যায় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের আগমন শুধু পরীক্ষায় পাশ করে একটি সনদ বগল দাবা নয়। বিশ্ববিদ্যালয় হল শিক্ষক শিক্ষার্থীদের একসঙ্গে জ্ঞান চর্চার অবারিত ক্ষেত্র। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার স্বার্থে একটি সুনির্দিষ্ট সিলেবাস থাকলেও ওই সিলেবাসকে ঘিরে শিক্ষার যে ব্যাপকতা রয়েছে, শিক্ষার সঙ্গে জীবনের অনুষঙ্গের তাল-লয় জ্ঞানের উন্মেষ ঘাটলে শুধু চাকরি নয় জীবনকে উপভোগ করার অনেক হাতিয়ার বা উপাদা সে আয়ত্ত করতে পারে। তবে সংখ্যায় নগণ্য হলেও কিছু শিক্ষার্থী স্ব উদ্যোগে জ্ঞান অন্বেষণে জীবনমুখী শিক্ষায় নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছে এবং দেশে-বিদেশে তারা সম্মানের সঙ্গে নিজের অবস্থান সংহত করেছে। এই কৃতিত্বপূর্ণ অবদান এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো তাৎপর্যপূর্ণভাবে উপস্থাপনে গণমাধ্যমের উদাসীনতা পরিলক্ষিত হয়েছে। দেশের সর্বক্ষেত্রে সর্ব প্রতিষ্ঠানে যোগ্যতা একনিষ্ঠতা সততা কে পাশ কাটিয়ে যেকোন উপায়ে তার কাঙ্খিত পথ পদবী কিংবা চাকরি বাগিয়ে নেয়া যেন একমাত্র লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে প্রতিটি প্রতিযোগীর হৃদয়। সমাজ তথা রাষ্ট্রে প্রকৃত জ্ঞানীর প্রতি অবজ্ঞা ও উদাসীনতা এই অনাকাঙ্ক্ষিত প্রতিযোগিতার মঞ্চকে সজ্জিত করেছে। ফলে কোনটা মানবিক কোনটা অমানবিক, কোনটা সততা কোনটা অসততা, কোনটা কাঙ্ক্ষিত কোনটা অনাকাঙ্ক্ষিত, কোনটা ত্যাগ, কোনটা উদারতা কোনটা স্বার্থপরতা, এবিষয়গুলো চিন্তা করার কোন সুযোগ তাদের মস্তিষ্কেই নেই। সব মিলিয়ে যেন এক অদ্ভুত উটের পিঠে প্রবল গতিতে এগিয়ে চলছে দেশ। যার পরিণাম কিন্তু আমরা ভোগ করতে চলেছি। শিক্ষার্থীরা কিন্তু এর জন্য দায়ী নয় এর জন্য দায়ী জ্ঞান পাপীরা। এর জন্য দায়ী রাষ্ট্র ব্যবস্থা। অতএব অর্থনৈতিক খাতের পাশাপাশি রাষ্ট্রের মৌলিক খাত হিসেবে চিহ্নিত করে শিক্ষাখাতে ব্যাপক সংস্কার এবং বাস্তবায়নের রূপরেখা প্রণয়ন জরুরি হয়ে পড়েছে।
শিল্প, সংস্কৃতি ও মানবিক শিক্ষা:
শিল্প মানুষের আত্মাকে সমৃদ্ধ করে এবং তাকে নতুন চিন্তা ও অনুভূতির জগতে প্রবেশ করতে সহায়তা করে। গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল বলেছেন, “শিক্ষার মূল লক্ষ্য হলো মনের সুষ্ঠু বিকাশ।” এই বিকাশের জন্য বইপাঠ ও প্রথাগত শিক্ষার পাশাপাশি, মানবিকতা ও সৌন্দর্যের চর্চা অপরিহার্য। মনীষী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও উল্লেখ করেছেন, “শিক্ষা শুধু জীবনের উপকরণ নয়, জীবন উপভোগ করার শিক্ষাও বটে।”
একটি গণতান্ত্রিক সমাজে নাগরিকদের শুধুমাত্র তথ্যসমৃদ্ধ করা নয়, বরং তাঁদের মানবিক ও নৈতিক শিক্ষার সাথেও পরিচিত করা জরুরি। পরিবার এবং প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা সমাজের ভিত্তি গড়ে তুলতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। শিল্প-সংস্কৃতি, বিশেষ করে নাটক, সংগীত, চিত্রকলা, এবং সাহিত্য, শিক্ষার্থীর মননে মানবিকতার বীজ বপন করে। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সমাজের উন্নয়ন ও পরিবর্তনের প্রধান হাতিয়ার হয়ে ওঠে সংস্কৃতি চর্চা।
ভৌগোলিক প্রভাব ও শিক্ষার অন্বেষণ:
একজন ব্যক্তি যে ভৌগোলিক অঞ্চলে বেড়ে ওঠে, তার সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস, জলবায়ু এবং সমাজের সাথে গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এই বিষয়গুলো শিক্ষার সাথে সংযুক্ত হলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে জীবন সম্পর্কে সুস্থ ও সুন্দর দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়। যেমন, জার্মান সমাজতাত্ত্বিক ম্যাক্স ওয়েবার তাঁর লেখায় উল্লেখ করেছেন, “মানুষের কর্ম ও জীবনধারার ওপর সংস্কৃতির গভীর প্রভাব রয়েছে।” সেই প্রভাবকগুলোর সঠিক ব্যবহারে শিক্ষাব্যবস্থা সুসংগঠিত হলে, সমাজে মানবিক মূল্যবোধের পরিস্ফুটন ঘটে।
শিক্ষার বাস্তবিক প্রয়োগ ও মনুষ্যত্বের বিকাশ:
বর্তমান সমাজে শিক্ষার্থীদের ওপর শিক্ষার চাপ শিক্ষাকে শুধু আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত করেছে। প্রকৃত শিক্ষা যেখানে শিক্ষার্থীদের জীবনকে অর্থপূর্ণ করে তোলে, সেখানে শুধুমাত্র পাঠ্যসূচিতে আটকে রাখা তাদের মানসিক বিকাশকে রুদ্ধ করে দেয়। ফরাসি দার্শনিক জঁ-জ্যাক রুশো বলেছেন, “মানুষ স্বাধীন জন্মগ্রহণ করে, কিন্তু সর্বত্র শৃঙ্খলিত।” সেই শৃঙ্খলা শিক্ষাব্যবস্থায়ও দৃশ্যমান, যেখানে শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবে সৃজনশীলতার অভাব বোধ করে।
এটি সমাজের উন্নতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় এবং শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য ব্যাহত করে। প্রাথমিক শিক্ষা থেকেই যদি শিশুকে মানবিকতা, নৈতিকতা এবং শিল্পের সৌন্দর্যের প্রতি আকৃষ্ট করা যায়, তবে সেই সমাজে সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশেষত বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে যে শিক্ষার্থীদের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধের অভাবই সমাজে হিংস্রতার সৃষ্টি করছে।
মানবিক সমাজ গঠনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ:
মানুষের প্রতি ভালোবাসা, সহানুভূতি, পরমত সহিষ্ণুতা, এবং জীবনকে উপভোগ করার শিক্ষা সমাজের প্রতিটি স্তরে প্রয়োগ করা জরুরি। ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক চর্চা এবং শিল্পের প্রয়োগিক দিকগুলো আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার অংশ করা দরকার। এভাবে গড়ে ওঠা একটি জাতি নিজেদের জীবনমান উন্নত করবে এবং সমাজ থেকে পাশবিকতা দূর করবে।
উপসংহার:
জীবনকে অর্থপূর্ণ ও উপভোগ্য করে তোলার জন্য শিক্ষার ভূমিকা অপরিসীম। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় যদি নৈতিকতা ও মানবিকতার চর্চা, শিল্পের সুসমন্বয় করা যায়, তবে সমাজে কেবল সনদ সর্বস্ব শিক্ষিত নয়, মনুষ্যত্বের উন্মেষ ঘটনো সম্ভব। শিক্ষা কেবল তাকে রুটি রুজি তৈরির জন্য প্রস্তুত করে না। জীবনকে নান্দনিক ভাবে পরিচালনা করার দীক্ষাদানও শিক্ষার কাজ। মানুষকে মানুষ হিসেবে সম্মান এবং তার অধিকার রক্ষার দায়িত্ব কিন্তু একজন শিক্ষিত মানুষের। একজন প্রকৃত শিক্ষিত মানুষ কখনো আত্মকেন্দ্রিক হয় না। তাই, একটি সুন্দর ও সহনশীল সমাজ গঠনে শিল্প, সংস্কৃতি এবং মানবিক শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম।
লেখক: ডক্টর মুহাম্মদ আবু বকর সিদ্দিক মিডিয়ায় ড.দিপু সিদ্দিকী হিসেবে পরিচিত। সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত।