কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি ।।
কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদের ৮টি দানবাক্স খুলে মোট ২৩ বস্তা টাকাসহ বৈদেশিক মুদ্রা ও সোনার গয়না পাওয়া গেছে। প্রতি তিন মাস পরপর দানবাক্সগুলো খোলা হয়।
এবার ৩ মাস ১৩ দিন পর শনিবার সকাল সোয়া ৮টার দিকে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ ও পুলিশ সুপার মোহাম্মদ রাসেল শেখ এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে দানবাক্সগুলো খোলা হয়েছে।
পরে দানবাক্স থেকে পাওয়া টাকাগুলো বস্তায় ভরে মসজিদের দোতলায় নিয়ে গণনা করা হয়। জেলা প্রশাসনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে টাকা গণনার কাজে রূপালী ব্যাংকের ৫০ জন স্টাফ, মসজিদ কমপ্লেক্সে অবস্থিত মাদ্রাসার ১১২ জন ছাত্র, মাদ্রাসা-এতিমখানা ও মসজিদ কমিটির ৩৪ জন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ১০ জন অংশ নিয়েছেন। টাকা গণনার এই এলাহী কাণ্ড নিজ চোখে অবলোকন করতে মসজিদের আশপাশে ভিড় করেন শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গসহ নানা শ্রেণি পেশার উৎসুক মানুষ। তাদের মধ্যে অনেকে এসেছেন দূর-দূরান্ত থেকে।
এর আগে সর্বশেষ গত ৬ মে মসজিদের দানবাক্স খুলে পাওয়া গিয়েছিল ১৯ বস্তা টাকা । তখন দিনভর গণনা শেষে পাওয়া যায় ৫ কোটি ৫৯ লাখ ৭ হাজার ৬৮৯ টাকা এবং বৈদেশিক মুদ্রা, সোনার গয়না ও হীরা। এছাড়া চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি ৩ মাস ১ দিন পর দানবাক্স খোলা হয়েছিল। তখন ২০টি বস্তায় ৪ কোটি ১৮ লাখ ১৬ হাজার ৭৪৪ টাকা এবং বৈদেশিক মুদ্রা, সোনার গয়না ও হীরা পাওয়া যায়। এছাড়াও প্রতিদিনই অসংখ্য মানুষ মসজিদটির দানসিন্দুকগুলোতে নগদ টাকা-পয়সা ছাড়াও স্বর্ণালঙ্কার দানের পাশাপাশি নিয়মিত গবাদিপশু, হাঁস-মুরগীসহ বিভিন্ন ধরনের জিনিসপত্রও দান করেন।
মসজিদের প্রশাসনিক কর্মকর্তা বীর মুক্তিযোদ্ধা শওকত উদ্দিন ভূঁইয়া জানান, পাগলা মসজিদ ও ইসলামী কমপ্লেক্সের খরচ চালিয়ে দানের বাকি টাকা ব্যাংকে জমা রাখা হয়। এ থেকে জেলার বিভিন্ন মসজিদ, মাদ্রাসা ও এতিমখানায় অনুদান দেয়া হয়। এছাড়া সমাজের অসহায় ও জটিল রোগে আক্রান্তদের সহায়তাও করা হয়।
সুউচ্চ মিনার ও তিন গম্বুজবিশিষ্ট তিনতলা বিশাল পাগলা মসজিদ কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক স্থাপনার মধ্যে অন্যতম। শহরের পশ্চিম হারুয়াস্থ নরসুন্দা নদীর তীরে মাত্র ১০ শতাংশ জমির ওপর মসজিদটি গড়ে উঠলেও বর্তমানে মসজিদ কমপ্লেক্সটি ৩ একর ৮৮ শতাংশ জায়গা আছে। এ মসজিদের পরিধির সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে এর খ্যাতি ও ঐতিহাসিক মূল্য। এরই মধ্যে দেশের অন্যতম আয়কারী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃত মসজিদটিকে পাগলা মসজিদ ইসলামী কমপ্লেক্স নামকরণ করা হয়েছে।
পাগলা মসজিদ পরিচালনা কমিটি সূত্রে জানা গেছে, ঐতিহ্যবাহী পাগলা মসজিদে আন্তর্জাতিক মানের দৃষ্টিনন্দন ইসলামিক কমপ্লেক্স নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যা এশিয়া মহাদেশের মধ্যে অন্যতম স্থাপত্য হিসেবে পরিগণিত হবে। এতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রাকৃতিক আলোর ব্যবস্থা থাকবে। দ্রুত এর কাজ শুরু হবে। যার নামকরণ হবে ‘পাগলা মসজিদ ইসলামিক কমপ্লেক্স’। এটি নির্মাণে প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে ১১৫ কোটি টাকা। সেখানে ৬০ হাজার মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারবেন। এছাড়া ৫ হাজার নারীর জন্য নামাজের আলাদা ব্যবস্থা থাকবে।
মানুষের ধারণা, খাস নিয়তে এই মসজিদে দান করলে মনের আশা পূর্ণ হয়। এ জন্য ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দূর-দূরান্ত থেকে অসংখ্য মানুষ এখানে এসে মানতের টাকা সোনা, রূপার গহনা দান করে থাকেন। বিশেষ করে প্রতি শুক্রবার দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এখানে মানত নিয়ে আসা বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষের ঢল নামে। আগতদের মধ্যে মুসলিমদের অধিকাংশই জুমার নামাজ আদায় করেন মসজিদে। আর এই ধারাবাহিকতা চলছে আড়াইশ’ বছরেরও বেশি সময় ধরে।
কথিত আছে, প্রায় ৫০০ বছর আগে ঈশা খাঁর আমলে ‘দেওয়ান জিলকদর খান ওরফে জিল কদর পাগলা’ নামে এক ব্যক্তি নদীর তীরে বসে নামাজ পড়তেন। পরবর্তী সময়ে ওই স্থানে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। পরে জিল কদর পাগলার নামানুসারেই মসজিদটি ‘পাগলা মসজিদ’ নামে পরিচিতি পায়। সময়ের বিবর্তনে আজ এ মসজিদের পরিধির সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে এর খ্যাতি ও ঐতিহাসিক মূল্যও।
অনেক বছর আগে মসজিদটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যে কিংবদন্তি আছে মসজিদটি গায়েবিভাবে নির্মিত হয়েছে। বর্তমানে মসজিদকে কেন্দ্র করে একটি অত্যাধুনিক ধর্মীয় কমপ্লেক্স এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সম্প্রসারিত হয়েছে মূল মসজিদ ভবনও।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ১৯৯৭ সাল থেকে পাগলা মসজিদটি ওয়াকফের আওতায় পরিচালিত হচ্ছে। তখন থেকে জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে মসজিদের সিন্দুক খুলে টাকা গণনা শুরু হয়।