স্টাফ রিপোর্টার:
পরীক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে এইচএসসি ও সমমানের স্থগিত পরীক্ষাগুলো বাতিল করা হয়েছে। এর ফলে পরীক্ষা শেষে ব্যবহারিক যে পরীক্ষা দিতে হয় সেটিও আর দেওয়া লাগবে না। তবে পরীক্ষার ফল কিভাবে প্রস্তুত ও প্রকাশ করা হবে সে বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত নেয়নি শিক্ষা মন্ত্রণালয়। আন্তঃশিক্ষা বোর্ড কমিটি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান তপন কুমার সরকার জানান, বৈঠকের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিয়ে এ বিষয়ে পরবর্তীতে জানিয়ে দেওয়া হবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা বাতিলের পক্ষে ছিল না মন্ত্রণালয়। পরীক্ষার্থীদের অল্প নম্বরে পরীক্ষা দেওয়ার বিষয়ে মত ছিল শিক্ষা ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদের। কিন্তু দীর্ঘ আন্দোলন ও অনেক পরীক্ষার্থীর মৃত্যু ও অন্ধত্ববরণ ও আহতের বিষয়টি পরীক্ষার্থীদের পক্ষে উপস্থাপন করা হয়।
সেময় মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতনরা পরীক্ষার্থীদের দাবি মেনে নিয়ে পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত নেন। পরে মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর ঢাকা শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যান তপন কুমার সরকার স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, অনিবার্য কারণবশত ২০২৪ সালের এইচএসসি ও সমমানের স্থগিত পরীক্ষাসমূহ বাতিল করা হলো। এ বিষয়ে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করা হলো।
মঙ্গলবার দুপুরে সচিবালয়ে স্থগিত এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষাগুলো আর দিতে চান না এবং অটোপাসের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পরীক্ষার্থীরা চান, ইতোমধ্যে যে কয়টি বিষয়ের পরীক্ষা হয়েছে, তার ভিত্তিতে এবং স্থগিত বিষয়ের পরীক্ষা এসএসসির সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সঙ্গে ম্যাপিং করে এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হোক। এই দাবিতে সোমবার ঢাকা শিক্ষা বোর্ড ঘেরাও করে তারা। মঙ্গলবারও পরিকল্পনা ছিল শিক্ষা বোর্ড ঘেরাও করার। কিন্তু শিক্ষার্থীরা যখন খবর পান বোর্ডের সব কর্মকর্তারা সচিবালয় অবস্থান করছেন তখন সচিবালয়ের সামনে তারা অবস্থান নেন।
সচিবালয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় যে ভবনে অবস্থিত, সেই ভবনের নিচে অসংখ্য শিক্ষার্থী জমায়েত হয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। প্রথম পর্যায়ে সচিবালয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সামনে বিক্ষোভ কর্মসূচি শেষে ১৮ তলা সিঁড়ি বেয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভেতরে ঢুকে পড়েন শত শত শিক্ষার্থী। এতে শিক্ষাসচিব অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। বাদ যাননি কোনো কর্মকর্তা। বিকেল ৪টায় তারা মন্ত্রণালয়ের ভেতরে প্রবেশ করে ‘আমাদের দাবি একটাই- পরীক্ষা বাতিল চাই’, ‘দাবি মোদের একটাই পরীক্ষা বাতিল চাই’, ‘আপস না সংগ্রাম-সংগ্রাম-সংগ্রাম’, ‘পরীক্ষা না বিকল্প, বিকল্প-বিকল্প’, ‘যুক্তি দিয়ে আন্দোলন-বন্ধ করা যাবে না’, ‘চলছে লড়াই-চলবে’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে থাকেন।
পরে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে দশ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল শিক্ষা উপদেষ্টা বরাবর একটি স্মারকলিপি প্রদান করেন। সে সময় শিক্ষার্থীদের বিষয়টির শান্তিপূর্ণ সমাধানের আশ্বাস দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ।
এর আগে মঙ্গলবার দুপুরে এইচএসসি ও সমমানের স্থগিত পরীক্ষাগুলো আরও দুই সপ্তাহ বা তার বেশি সময় পিছিয়ে দেওয়া হবে বলে সিদ্ধান্ত নেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
একই সঙ্গে স্থগিত বিষয়গুলো পরীক্ষায় অর্ধেক প্রশ্নপত্রের উত্তর লিখতে হবে পরীক্ষার্থীদের। কোনো বিষয়ে যদি আগে আটটি প্রশ্নের উত্তর দিতে হতো, তাহলে এখন দিতে হবে চারটির। এজন্য তারা পূর্ণ সময়ই পাবেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের সভাপতিত্বে জরুরি সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
টানা দুই মাস ধরে এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা নিয়ে ধুঁকেছে পরীক্ষার্থীরা। দফায় দফায় স্থগিত হয়েছে এই পরীক্ষা। সরকার পতন ও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সময় পুড়েছিল প্রশ্ন ও উত্তরপত্র। এ সময় পরীক্ষার্থীদের মধ্যে মানসিক ধকলও গিয়েছে বেশ। অনেক পরীক্ষার্থীকেই কারাবরণ করতে হয়। যে কারণে স্থগিত পরীক্ষা বাতিলের দাবিতে আন্দোলন করছিলেন পরীক্ষার্থীরা।
তবে পরীক্ষার্থীরা বলছেন, ২০২৪ সালের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় যারা অংশ নিয়েছেন তারা ২০২২ সালে এসএসসি পরীক্ষা দেন। সে সময় বন্যা ও করোনার কারণে প্রতিটি বিষয়ে ৫০ নম্বরে পরীক্ষার মাধ্যমে সমন্বয় শেষে তাদের ফল প্রকাশ করা হয়। এ ছাড়াও ওই সময় তিন বিষয়ে তারা কোনো পরীক্ষা দেননি। সেগুলো হচ্ছে আইসিটি, বাংলাদেশ ও বিশ^ পরিচয় এবং ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা। জেএসসি পরীক্ষায় নম্বরের সঙ্গে সমন্বয় করে এসব বিষয়ের ফল নির্ধারণ করা হয় বলেও তারা জানান।
সূত্র বলছে, এর আগে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেন এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার্থীরা। এতে অসংখ্য পরীক্ষার্থী হতাহত হন। কোটা আন্দোলনকে ঘিরে অনেক এইচএসসি পরীক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করে বিভিন্ন মামলা দেওয়া হয়। তাদের অবস্থান ছিল কারাগারে। যে কারণে পরীক্ষার তারিখ ঘোষণার পরও পরীক্ষা দিতে অস্বীকৃতি জানান বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা। তারা পরীক্ষা না দেওয়ার দাবিতে সড়কে নেমে আসেন।
তারও আগে গত ১৮ জুলাইয়ের এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত করে শিক্ষা বোর্ড। এরপর পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ায় ২১, ২৩ ও ২৫ জুলাইয়ের সব পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। তৃতীয় দফায় ২৮ জুলাই থেকে ১ আগস্ট পর্যন্ত সময়সূচি অনুযায়ী যত পরীক্ষা ছিল, তা সব স্থগিত করে আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটি। এরপর স্থগিত এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা শুরু হতে অন্তত এক মাস সময় লাগবে বলে জানিয়েছিলেন ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার।
তিনি জানান, সব প্রশ্নপত্র পুড়ে যাওয়ায় নতুন করে আবারও প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও সারাদেশে সরবরাহ করতে হবে। তা করতে অন্তত এক মাস প্রয়োজন। এ কারণে তিনি এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেন।
গত ৩০ জুন সিলেট বোর্ড বাদে সব শিক্ষা বোর্ডের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা শুরু হয়। রুটিন অনুযায়ী ৮ দিন পরীক্ষা হওয়ার পর কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে ১৮ জুলাইয়ের সব পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। সূচি অনুযায়ী, ১৩ দিনের মোট ৬১টি বিষয়ের পরীক্ষা গ্রহণ বাকি ছিল। সর্বশেষ সব পরীক্ষা স্থগিত করে ১১ আগস্ট থেকে নতুন সময়সূচি অনুযায়ী পরীক্ষা গ্রহণের কথা বলা হয়। কিন্তু পরে জানানো হয় ১১ আগস্ট পরীক্ষা হচ্ছে না।
সর্বশেষ ১১ সেপ্টেম্বর থেকে স্থগিত পরীক্ষাগুলো নেওয়ার কথা হয়েছিল। তবে ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পদত্যাগ ও সৃষ্ট বর্তমান পরিস্থিতিতে পরীক্ষা নেওয়ার সুযোগ নেই বলে জানায় বোর্ডগুলো। চলতি বছর ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ড, কারিগরি বোর্ড ও মাদ্রাসা বোর্ডের অধীনে মোট পরীক্ষার্থী ১৪ লাখ ৫০ হাজার ৭৯০ জন।