শামছুদ্দিন খোকন, চরফ্যাশন, ভোলা।।
আরো পড়ুন
আজ সেই ভয়াল ১২ নভেম্বর। ভোলাসহ উপকূলবাসীর বিভিষীকাময় দুঃস্বপ্নের দিন। এক এক করে ৪৫ বছর পেরিয়ে গেলেও আজও কান্না থামেনী স্বজন হারা মানুষের। ১৯৭০ সালের এই দিনে বিচ্ছিন্ন এলাকা লন্ডভন্ড হয়ে ধ্বংস লীলায় পরিনত হয়। মুহুত্বের মধ্যেই প্রলংয়নকারী ঘুর্ণী ও জলচ্ছাস ক্ষত বিক্ষত করে দেয় স্থানীয় জনপথ। মৃত্যু পুরীর হাত থেকে রক্ষাপেতে দৌড়াদৌড়ী ছুটাছুটির আপ্রাণ চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত ব্যার্থ হন তারা। হারিয়ে যায় লক্ষ্যধিক প্রাণ। নিখোঁজ হয় সহস্রাধিক মানুষ। দূর্গম এলাকায় হতদরিদ্রদের একমাত্র আয়ের উৎস্য গবাদি পশুগুলো ভাসিয়ে নিয়ে যায়। বেঁড়ীবাধ, জলাভুমি, জংগলসহ বিভিন্ন প্রান্তে স্বজন হারা মানুষগুলো তাদের প্রিয়জনের লাশ খুজে পায়নি। জলচ্ছাসের পর থেকে দেড়মাস পর্যন্ত স্বজন হারানোদের কান্নায় উপকুলের আকাশ পাতাল ভারী ছিল। গত ৫০ বছরের সব কয়টি ঘুর্নীঝড়ের চেয়ে ৭০’র ঝড়টি সব চাইতে হিংস্র ছিল বলে দাবী করছেন প্রত্যক্ষ দর্শীরা। ৭০’র এর হারিকেলরুপী জলচ্ছাসের সময় ঝড়টি উপকূলীয় ভোলা, বরিশাল, বরগুনা, লক্ষ্মীপুর, পটুয়াখালী, বাগেরহাট, খুলনাসহ ১৮ টি জেলায় আঘাত হানে। তৎকালীন সময় তথ্যপ্রযুক্তি অনেকটা দুর্বল থাকায় উপকুলে অনেক মানুষই ঝড়ের পূর্বভাস পায়নি। এসময় জলচ্ছাস হয়েছিল ৮/১০ ফুট উচ্চতায়। কেউ গাছের ডালে, কেউ উচু ছাদে আশ্রয় নিয়ে কোনমতে প্রানে রক্ষা পেলেও ৩/৪ দিন তাদের অভুক্ত কাটারে হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, উপকুলীয় জেলাগুলির মধ্যে ক্ষয়ক্ষতি বেশী হয়েছে দ্বীপ জেলা ভোলায়। এ সময় ভোলার এক তৃতীয়াংশ লন্ডভন্ড হয়। ১২ নম্বর মহা বিপদ সংকেতের সামুদ্রিক জলচ্ছাসটি অলৌকিক ভাবে ভাসিয়ে নিয়ে যায় হাজার হাজার মানুষের প্রাণ। সেই দিনের ভয়াল স্মৃতির বর্ণনা করতে গিয়ে চর মানিকা ইউনিয়ন চর আইচা গ্রামের নুর হোসেন মাষ্টার যানান
সেদিন ছিল রোজার মাস। সকাল থেকেই মেঘে আচ্ছন্ন ছিল। দুপুরের পর থেকে আস্তে অস্তে বাতাস বইতে শুরু হয়। বিকেলের দিকে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। সন্ধ্যায় বাতাসের বেগ বাড়তে থাকে। সন্ধ্যার পর বাতাস ও বৃষ্টির প্রচন্ডতা বেড়ে যায়। রাত ২ টা আড়াইটার দিকে মেঘনা-তেতুঁলিয়া ও বঙ্গোপসাগরের জলচ্ছাসের পানি ১৪ ফুট উচুঁ বেড়িবাধের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গোটা জেলা তলিয়ে যায়। এ সময় মির্জাকালু বাজারের সদর রোডে হাটুর ওপরে ( ৩/৪ ফুট) পানি ওঠে। ’পানি আসতেছে’ বলে বাজারের আশ-পাশ থেকে বহু নারী, পুরুষ ও শিশু ছুটোছুটি করে স্কুলের দোতলায় আশ্রয় নেন। তিনি বলেন, পরদিন ১৩ নভেম্বর ভোরে পানি যখন নামতে শুরু করে তখন প্রচন্ড বেগে জলচ্ছাসের পানির স্রোতে মাছ ধরার ট্রলার ও লঞ্চ পানিতে ভেসে যাচ্ছে অগনিত মানুষের লাশ। বিভিন্ন গাছের মাথায় ঝুলতে দেখা গেছে মানুষ ও পশুর মৃতদেহ। চারিদিকে শুধু লাশ আর লাশ। যেন লাশের মিছিল হয়েছিল ৭০’র জলচ্ছাসে। গোটা জেলাকে তছতছ করে দিয়েছে। যেন মৃত্যুপূরীতে পরিনত হয়েছিল এ জেলার জনপদ। ঝড়ের বর্ণনা করতে গিয়ে ষাটার্ধ্ব বৃদ্ধা মনপুরার মফিজা খাতুন বলেন, সেই ভয়াল সাম্রদ্রিক জলচ্ছাস ও ঘুর্নি ঝড়ের সময় অথৈ পানিতে একটি ভাসমান কাঠ ধরে প্রায়মৃত অবস্থায় গভির সাগরের দিকে তিনি ভেসে যাচ্ছিলেন।
চরফ্যাশনের চর কুকরী-মুকরী ইউনিয়নের বাসিন্দা বাদশা মাষ্টার বলেন, ওই বন্যায় এ অঞ্চলে ১৩/১৪ ফুট পানি ওঠেছিল। ঝড়ে তিনি ১ মেয়ে ও ১ ছেলে হারিয়েছেন। প্রতি বছর এ দিন এলে তিনি তাদের স্বরন করে ধুকে ধুকে কাদেন। ভোলার ইতিহাস যতদিন থাকবে ঠিক ততদিনই উপকুলীয় বাসী (১২ নভেম্বর) এই দিনটির কথা কোনদিনই ভুলবেন না। এদিকে, কাল১২ নভেম্বর এ দিনকে স্মরন রাখতে ভোলাসহ বিভিন্ন উপজেলায় দোয়া মাহফিলের আয়জন করা হয়েছে।